কর্মযোগ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় পর্ব :Swami Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History

কর্মযোগ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় পর্ব :Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History 
Swami Vivekananda

যাবতীয় স্কুল ও সূক্ষ্ম বস্তু হইতে আত্মাকে পৃথক করাই আমাদের লক্ষ্য। এই অবস্থা লাভ হইলে বােধ হইবে, আত্মা সর্বকালে একাই বিদ্যমান ছিলেন তাহাকে সুখী করার জন্য অন্য কাহারও প্রয়োজন নেই। সুখী হবার জন্য আমরা যতদিন অন্যের উপর নির্ভরশীল থাকিব, ততদিন আমরা ক্রীতদাস
পুরুষ’ যখন দেখেন তিনি মুক্ত, তাহার পূর্ণতার জন্য কিছুরই প্রয়োজন নেই এবং এই প্রকৃতি সম্পূর্ণ অনাবশ্যক, তখন মুক্তি বা ‘কৈবল্য লাভ হয়। কয়েকটা ডলারের প্রত্যাশায় মানুষ ছুটাছুটি করে এবং ইহার জন্য সে তোমার প্রতিবেশীকে প্রতারণা করতে কুণ্ঠিত হয় না। কিন্তু তোমার যদি নিজেদের সংযত করতে পারে, তবে কয়েক বৎসরের মধ্যে তাদের চরিত্র এরূপ উন্নত হবে যে, তখন তাহার ইচ্ছা করলে লক্ষ লক্ষ ডলার উপার্জন করিতে পারিবে। তখন তাহাদের ইচ্ছাশক্তি জগৎকে নিয়ন্ত্রিত করিবে। কিন্তু আমরা সব বড়ই নির্বোধ একজনের ভুলত্রুটির কথা সর্বসমক্ষে বলিয়া লাভ কি এভাবে ত্রুটি সংশােধিত হয় না।
 কারণ কৃতকর্মের জন্য মানুষকে দুঃখ ভােগ করিতে হইবেই। অবশ্যই চেষ্টা করিয়া উন্নতিলাভ করিতে হইবে। যাহারা দৃঢ় এবং শক্তিশালী, জগৎ তাহাদেরই প্রতি সহানুভূতিশীল। যে-কাজ মানবজাতি ও
প্রকৃতির উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছাপ্রণােদিতভাবে করিয়া দেওয়া হয়, তাহাই আসক্তি বা বন্ধনের কারণ হয় না। কোন প্রকার কর্তব্য কর্মই তুচ্ছ নয়। নিম্নতর কার্য করে বলিয়াই একজন যে উচ্চতর কার্য করে তাহার তুলনায় নিম্নস্তরের হয় না। কে কিরূপ কর্তব্য করিতেছে দেখিয়া মানুষকে বিচার করা উচিত নয় ; সেই কর্তব্য সে কিভাবে সম্পাদন করিতেছে, তাহা দেখিয়া বিচার করা উচিত। ঐ কার্য করিবার ধরন এবং শক্তিই মানুষের যথার্থ পরীক্ষা। প্রত্যহ আবােল-তাবােল বকিয়া থাকেন, এমন একজন অধ্যাপক অপেক্ষা যে মুচি নিজ ব্যবসায় ও কর্ম অনুসারে অতি অল্পসময়ের মধ্যে একজোড়া সুন্দর মজবুত জুতা প্রস্তুত।
করিতে পারে, সে বড়। প্রত্যেক কর্মই পবিত্র এবং কর্তব্যনিষ্ঠাই ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ উপাসনা। বদ্ধ
ব্যক্তিদের মােহগ্রস্ত ও অজ্ঞনাচ্ছিন্ন আত্মাকে মুক্ত করিতে এবং জ্ঞানালােক দিতে কর্তব্য প্রভূত সহায়তা করে, সন্দেহ নাই। আমাদের অতি নিকটেই যে কর্তবা রহিয়াছে যাহা এখন আমাদের হাতে আছে, তাহা উওমরূপে সম্পাদন করিয়াই আমরা ক্রমশঃ শক্তি লাভ করি।
এইরূপে ধারে ধীরে শক্তি বৃদ্ধি করিয়া আমরা এমন এক অবস্থায় উপনীত হইতে পারি যে, জীবনে ও সমাজে সর্বাপেক্ষা লােভনীয় ও সম্মানজনক কর্তব্য সম্পাদনের (গীরব ও অধিকার আমরা লাভ করিব। প্রকৃতির বিচার সর্বত্রই সমানভাবে কঠোর এবং নির্দয় হইয়া থাকে। সর্বাপেক্ষা অধিক ব্যবহারিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির নিকট জীবন ভাল বা মন্দ কোনটিই নয়। প্রত্যেক সফলকাম ব্যক্তিই কৃতকার্যতার পশ্চাতে কোথাও অসাধারণ দৃঢ়তা ও ঐকান্তিকতা বর্তমান। ইহাই তাহার জীবনে বিরাট সফলতার হেতু। সে হয়তাে সম্পূর্ণ স্বার্থশূন্য হইতে পারে নাই, কিন্তু সে ক্রমশঃ এই আদর্শের দিকেই অগ্রসর হইতেছিল। সে যদি সম্পূর্ণরূপে স্বাশিন্য হইতে পারিত, তবে তাহার জীবন বুদ্ধ বা খ্রীস্টের জীবনের মতাে মহান ও সার্থক হইতে পারিত। স্বার্থশূন্যতার তারতম্যের উপরই সর্বক্ষেত্রে সফলতার তারতম্য নির্ভর করে। মানবজাতির মহান নেতৃবৃন্দ নির্দিষ্ট সাধারণ কর্মক্ষেত্র অপেক্ষা উচ্চতর
কর্মক্ষেত্রের জনাই আসেন। আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন, এমন কোন কার্য হইতে পারে না, যাহা সম্পূর্ণ পবিত্র বা একেবারে অপবিত্র এখানে ‘পবিত্রতা' অথবা 'অপবিত্রতা হিংসা বা অহিংসা অর্থে গ্রহণ করতে হবে। আমরা অপরের অনিষ্ট না করিয়া স্বাস-প্রশ্বাস ত্যাগ বা জীবনধারণ করিতে পারি না। আমাদের প্রত্যেক
অমুষ্টি অপরের মুখ হইতে কাড়িয়া লওয়া। আমাদের বাচিয়া জগৎ জুড়িয়া থাকার দরুন অপর কতকগুলি প্রাণীর স্থানাভাব হইতেছে হয়তাে কোন মানুষের বা অপর প্রাণীর বা কোন ছােট উদ্ভিদের কিন্তু যাহারই হউক না।
কেন, আমরা কোন না কোন প্রাণীর স্থান সঙ্কোচ করিবার কারণ হইয়াছি। হাই যদি হইল, তবে স্বভাবতই ইহা বুঝা যাইতেছে যে, কর্মের দ্বারা কখনাে পূর্ণতা লাভ হয় না। অমিরা অনন্তকাল কাজ করিয়া যাইতে পারি, কিন্তু এই করিয়া যাইতে পারি, কিন্তু কাজ কখনাে শেষ হইবে না। জটিল সংসার-যন্ত্র হইতে বাহির হইবার পথ পাইব না; আমরা ক্রমাগত কাজ যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় এবং ভালবাসার সহিত কাজ করে, ফলাফলের প্রতি তাহার দৃষ্টি থাকে না। কিন্তু ক্রীতদাসকে চাবুক মারার প্রয়ােজন হয় ; ভূত পারিশ্রমিক চায়। জীবনের সর্বত্র এইরূপ। জনসভার কোন বক্তা একটু বাহক। চায়। এইগুলি না দিয়া যদি তাহাকে এক কোণে ফেলিয়া রাখা যায়, তবে তাহার মৃত্যু হইবে, কেন না এইগুলি তাহার প্রয়ােজন। ইহাই ক্রীতদাসের ভাবে কাজ করা। এরূপ অবস্থায় প্রতিদানে কিছু আশা করা অভ্যাস হইয়া পড়ে। ইহার পর ভৃত্যের মতাে কর্ম করা। কৃত্যের প্রয়ােজন পারিশ্রমিকের-আমি ইহ দিতেছি, তুমি উহা দাও।' কর্মের জন্য কর্ম করি' এ-কথা বলার মতাে সহজ আর কিছুই নাই। কিন্তু এইভাবে কর্ম করার মতাে কঠিন
আর কিছুই নাই। কর্মের জন্য কম করে এইরূপ কোন ব্যক্তিকে দর্শন করিবার জন্য কষ্ট স্বীকার করিয়াও বদর যাইতে রাজি আছি। কোথাও হয়তাে একটি অভিসন্ধি থাকে। যদি অর্থের অভিসন্ধি না হয়, তবে প্রত্বের মতলব। যদি প্রভুত্ব না হয়, তবে লাভের উদ্দেশ্য। কোনরূপে কোথাও একটি প্রেরণা থাকিবেই। তুমি আমার বন্ধু, আমি তােমার জন্য তােমার সহিত কাজ করিতে চাই। এ পর্যন্ত বেশ চমৎকার এবং প্রতি মুহূর্তে আমি আমার আন্তরিকতা ঘােষণা করিতে পারি। কিন্তু সাবধান, তােমাকে আমার সহিত নিশ্চয়ই একমত হইতে হইবে। যদি তুমি একমত হইতে না পার, তবে আমি আর তােমায় দেখিব না বা তােমায় সাহায্য করিব না! এরূপ অভিসন্ধিমূলক কর্ম দ্বারা দুঃখ হয়। মনকে বশে রাখিয়া আমরা যে কাজ করি, সে-কাজই অনাসক্তি ও আনন্দের কারণ হয়। একটি মহৎ শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, আমার মাপকাঠিতে সমগ্র জগৎকে বিচার করিলে চলিবে না। প্রত্যেক লােককে তাহার ভাব অনুযায়ী বিচার করিতে হইবে, প্রত্যেক জাতিকে উহার আদর্শ অনুযায়ী এবং প্রতিটি প্রদেশের প্রতিটি রীতি-নীতি নিজস্ব যুক্তি ও অবস্থা অনুসারে বিচার করিতে হইবে। আমেরিকানরা যে পারিপার্শ্বিকের মধ্যে বাস করে, তাহার প্রভাবেই আমেরিকাবাসীদের রীতি-নীতির উদ্ভব হইয়াছে, এবং ভারতবাসীদের পরিবেশের ফলেই ভারতীয় রীতি-নীতির উদ্ভব। এইভাবে চীন, জাপান
প্রভৃতি দেশের পক্ষে ও এ-কথা প্রযােজ্য।
কর্মযোগ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় পর্ব :Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History
Swami Vivekananda 
আমাদের যােগ্যতা অনুযায়ী আমাদের পরিবেশ গড়িয়া ওঠে। খেলার সময় প্রতিটি গােলক উহার যথানির্দিষ্ট গর্তে গিয়া পতিত হয়। যদি একজনের কর্মক্ষমতা অপরের চেয়ে বেশি হয়, তবে সাংসারিক বিন্যাসে তাহা ধরা পড়িবেই। সুতরাং অভিযােগ করিয়া কোন লাভ নাই। কোন একজন ধনী হয়তাে দুষ্ট, কিন্তু তাহার মধ্যে এমন কতকগুলি গুণের সমাবেশ হইয়াছে,
যাহার ফলে সে ধনী হইয়াছে। অনা যে-কোন ব্যক্তির মধ্যে এই গুণগুলি থাকিলে সেও ধনশালী হইতে পারিবে। পরস্পর বিবাদ এবং অভিযােগ
করিয়া কি ফুল ইহা দ্বারা আমাদের অবস্থার কোন উন্নতি করিতে পারি তবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সে অভিযােগ করিবে। সর্বক্ষণ অসন্তুষ্ট
না। কাহাকেও ছােট কিছু করিতে হইতেছে বলিয়া যদি সে অভিযােগ করে, থাকে, সেই আলােকের সন্ধান পায় এবং উচ্চ হইতে উচ্চতর কর্তব্য তাহার থাকিয়া তাহার জীবন দুঃখময় হইয়া উঠিবে এবং সমস্ত কিছুই পণ্ড হইবে। কিন্তু যে ব্যক্তি তাহার কর্তব্য কর্মে নিয়ত অবিচল থাকিয়া অগ্রসর হইতে নিকট আসিয়া উপস্থিত হয়।

No comments:

Powered by Blogger.