কর্মযােগ প্রসঙ্গ : কর্ম বা কার্য ও তাহার রহস্য :Swami Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History

কর্মযােগ প্রসঙ্গ : কর্ম বা কার্য ও তাহার রহস্য :Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History 
কর্মযােগ প্রসঙ্গ : কর্ম বা কার্য ও তাহার রহস্য :Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History
SwamiVivekananda

আমার জীবনে যে-সব শ্রেষ্ঠ শিক্ষা লাভ করিয়াছি, সেগুলির অন্যতম এই যে, কর্মের উদ্দেশ্যের প্রতি যতটা মনােযােগ দেওয়া আবশ্যক, উপায়গুলির প্রতিও ততটা দেওয়া উচিত। এই শিক্ষা আমি যাহার নিকট লাভ করিয়াছি, তিনি একজন মহাপুরুষ, এবং তাহার জীবন ছিল এই মহতী নীতির বাস্তব রূপায়ণ। এই একটি নীতি হইতেই আমি সর্বদা মহৎ শিক্ষা লাভ করিয়া আসিতেছি; এবং আমার মনে হয়, জীবনের সকল সাফল্যের রহস্য সেখানেই অর্থাৎ উদ্দেশ্যের প্রতি যতটা, উপায়গুলির প্রতিও ততটা
মনােযােগ দেওয়া। আমাদের জীবনের বড় ত্রুটি এই যে, আমরা আদর্শের প্রতি এত বেশি আকৃষ্ট হইয়া পড়ি লক্ষ্য আমাদের নিকট এত বেশি মনােমুগ্ধকর, এত বেশি লােভনীয় হয় এবং আমাদের মানসপটে এত বড় হইয়া যায় যে, আমরা উপায়গুলি খুঁটিনাটিভাবে দেখিতে পাই না; কিন্তু যখনই বিফলতা আসে, তখন যদি আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করিয়া দেখি, তবে শতকরা নিরানব্বইটি ক্ষেত্রে দেখিব যে, উপায়গুলির প্রতি মনােযােগ দিই নাই বলিয়াই আমরা বিফল হইয়াছি। উপায়গুলিকে নিখুঁত ও দৃঢ় করার দিকে মনােযােগ দেওয়াই আমাদের বিশেষ প্রয়ােজন। উপায়গুলি যথাযথ হইলে উদ্দেশ্যসিদ্ধি হইবেই। আমরা ভুলিয়া যাই যে, কারণই কার্য উৎপাদন করে  কার্য কখনই নিজে নিজে উৎপন্ন হইতে পারে না; কারণগুলি ঠিক, উপযুক্ত ও শক্তিশালী না হইলে কার্য কখনাে উৎপন্ন হইবে না। একবার যখন আদর্শ নির্বাচিত ও উহার উপায়গুলি নির্ধারিত হয়, তখন আর আদর্শের কথা না। ভাবিলেও পারি; কারণ উপায়গুলি নিখুঁত করিতে পারিলে আদর্শের বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হইতে পারি; যেখানে কারণ আছে, সেখানে কার্য সম্বন্ধে আর কোন বাধা নাই, কার্য অবশ্যই হইবে; আমরা যদি কারণ বিষয়ে যত্নবান হই, তাহা হইলে কার্যও হইবে। আদর্শের উপলব্ধিই কার্য, উপায়গুলিই কারণ ;
সুতরাং উপায়ের প্রতি মনােযােগদানই জীবন-সমস্যা সমাধানের রহস্য। এই বিষয়টি আমরা গীতাতেও পাঠ করিয়া থাকি; সেখানে আমরা এই শিক্ষা পাই যে, আমাদের কাম্ফ করিতে হইবে, সমগ্র শক্তি দিয়া নিয়ত কাজ করিয়া যাইতে হইবে; এবং যে কোন কাজেই আমরা নিযুক্ত হই না কেন, তাহার উপর আমাদের সমগ্ৰ মন সমাহিত করিতে হইবে; অথচ দেখিতে হইবে,
আমরা যেন কমে আসক্ত হইয়া না পড়ি, অর্থাৎ অন্য কোন কিছুর প্রভাবে যেন কর্ম হইতে সরিয়া যাই, কিন্তু তবু সর্বাবস্থাতেই যেন ইচ্ছামাত্র আমরা
কর্মত্যাগ করিতে সমর্থ হই। আমরা যদি নিজ নিজ জীবন বিশ্লেষণ করি, তাহা হইলে দেখিতে পাই, যে, আমাদের দুঃখের সবচেয়ে বড় কারণ এই আমরা কোন কাত এ হণ করিয়া তাহাতে আমাদের সমস্ত শক্তি নিয়ােজিত করি ; হয়তাে তাহা নিস্থল হইল, তথাপি আমরা তাহা পরিত্যাগ করিতে পারি না। আমরা জানি, কর্ম আমাদিগকে আঘাত দিতেছে, কর্মের প্রতি আরও বেশি আসক্তি আমাদের কেবল দুঃখই দিতেছে তথাপি আমরা ঐ কর্ম হইতে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করিতে পারি না। মক্ষিকা মধুপান করিতে আসিয়াছিল, কিন্তু তাহার পাগুলি মধুভাণ্ডে আটকাইয়া গেল! সে আর বাহির হইতে পারিল না।
 বার বারই আমাদের এরূপ দুরবস্থা হইতেছে। আমাদের সমগ্র জীবনই এইরূপ একটা রহস্যে আবৃত। কেন আমরা এ জগতে আসিয়াছি? আমরা এখানে মধুপান করিতে আসিয়াছিলাম, কিন্তু দেখিতে পাইতেছি আমাদের হাত-পা উহাতে আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছে! আমরা জগৎকে ধরিতে আসিয়াছিলাম, কিন্তু নিজেরাই ধৃত হইয়া পড়িলাম ভােগ করিতে আসিয়াছিলাম, কিন্তু আমরাই ভূক্ত হইতেছি শাসন করিতে আসিয়াছিলাম, কিন্তু নিজেরাই শাসিত হইতেছি।
কাজ করিতে আসিয়াছিলাম, কিন্তু অপরের হস্তে ক্রীড়নক হইয়া পড়িতেছি এরপ ব্যাপার আমরা সর্বদাই দেখিতে পাই। আমাদের জীবনে প্রত্যেক ছোটখাট ব্যাপারে এইরূপই ঘটিয়া থাকে। অপরের মন-বুদ্ধি দ্বারা
আমরা চালিত হইতেছি; আবার আমরা সর্বদাই অপরের মন-বুদ্ধির উপর প্রভাব বিস্তার করিতে চেষ্টা করিতেছি। আমরা জীবনের সুখস্বাচ্ছন্দ্য উপভােগ। করিতে চাই, কিন্তু সেগুলিই আমাদের প্রাণশক্তি ক্ষয় করিয়া ফেলে। আমরা চাই প্রকৃতি হইতে কিছু আহরণ করিতে, কিন্তু পরিণামে দেখিতে পাই, প্রকৃতিই আমাদের সর্বস্ব কাড়িয়া লয় আমাদিগকে একেবারে রিক্ত করিয়া ফেলিয়া দেয়। যদি এরূপ না হইত, তবে জীবন আনন্দোজ্জল হইয়া উঠিত। এগুলি কখনাে গ্রাহ্য করিও না। আমরা যদি বিষয়ে জড়িত হইয়া না পড়ি, তাহা হইলে সর্ববিধ সফলতা ও বিফলতা, সুখ ও দুঃখ সত্ত্বেও আমাদের জীবন অবিরাম আনন্দোজ্জ্বল হইতে পারে। দুঃখের ইহাই একটি কারণ যে, আমরা আসক্ত হই; আমরা নিত্য আবদ্ধ হইতেছি। এজন্য গীতা বলিতেছেন নিয়ত কর্ম কর; কর্ম কর, কিন্তু আসক্ত হইও না ; কর্মে বদ্ধ হইও না। প্রত্যেক বিষয় হইতে নিজেকে প্রত্যাহৃত করিবার শক্তি সঞ্চিত রাখ কোন বস্তু যত প্রিয়ই হউক না কেন, তাহা পাইবার জন্য মন যত বেশিই ব্যাকুল হউক না কেন, তাহা ত্যাগ করিতে গেলে যত তীব্র বেদনা অনুভব কর না কেন, প্রয়ােজনকালে তাহা পরিত্যাগের শক্তি নিজের মধ্যে সঞ্চিত রাখ। এই জীবনেই হউক বা অন্য কোন জীবনেই হউক দুর্বলের স্থান নাই, দুর্বলতা দাসত্ব আনে। দুর্বলতা সর্বপ্রকার শারীরিক ও মানসিক দুঃখের কারণ। দুর্বলতাই মৃত্যু। শতসহস্র জীবাণু আমাদের চারিদিকে বিচরণ করিতেছে; কিন্তু যে পর্যন্ত না আমরা
দুর্বল হইয়া পড়ি, যে পর্যন্ত না আমাদের দেহ ঐগুলি গ্রহণ করিবার জন্য পর্বেই প্রস্তুত ও উন্মুখ হয়, সে পর্যন্ত ঐ জীবাণুগুলি আমাদের অনিষ্ট করিতে। পারে না। লক্ষ লক্ষ দুঃখের জীবাণু আমাদের চারিদিকে ভাসমান থাকিতে হয়, সেগুলি আমাদের নিকট আসিতে সাহস করিবে না; আমাদিগকে আয়ত্ত পারে; ঐগুলিকে গ্রাহ্য করিলে চলিবে না। যে পর্যন্ত আমাদের মন দুর্বল না করিবার কোন শক্তি তাহাদের নাই। জীবনের পরম সত্য এই শক্তিই জীবন, দুর্বলতাই মৃত্যু। শক্তিই সুখ ও আনন্দ ; শক্তিই অনন্ত ও অবিনশ্বর জীবন ; এই জীবনে যাবতীয় ইন্দ্রিয়- সুখের উৎস আসক্তি। আমরা আমাদের দুর্বলতাই অবিরাম দুঃখ ও উদ্বেগের কারণ ; দুর্বলতাই মৃত্যু।
বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি আসক্ত হই; নিজেদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাপারে আসক্ত হই; যাবতীয় বাহ্যবস্তুতে আসক্ত হই, যাহাতে ঐগুলির সাহায্যে ইন্দ্রিয়সুখ লাভ করিতে পারি। আবার এই আসক্তি ভিন্ন আর কি আছে, যাহা আমাদের দুঃখ দিতে পারে আনন্দ অর্জন করিতে হইলে আমাদিগকে আসক্তিহীন হইতে হইবে। ইচ্ছামাত্র অনাসক্ত হইবার শক্তি যদি আমাদের
থাকিত, তবে কোন দুঃখই থাকিত না। কেবল সেই ব্যক্তিই প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ বক্তলাভে সমর্থ হইবেন, যিনি সমগ্র শক্তি দিয়া কোন বস্তুতে আসক্ত হইবার সামথ্য লাভ করিয়াও প্রয়ােজনকালে নিজেকে অনাসক্ত করিবারও শক্তি ধারণ করেন। কিন্তু মুশকিল এই যতটুকু আসক্ত হইবার ক্ষমতা থাকা দরকার,
ততটুকু অনাসক্ত হইবার ক্ষমতাও থাকা উচিত। আবার এমন সব ব্যক্তি আছে, যাহারা কোন ক্ষি দ্বারা আকৃষ্ট হয় না। তাহারা ভালবাসিতে পারে না; তাহারা কঠিনহৃদয় ও উদাসীন। অবশ্য জীবনের অধিকাংশ দুঃখ তাহারা এড়াইয়া যায়। কিন্তু দেওয়াল কখনাে দুঃখবােধ করে না, কখনাে ভালবাসে। না, কখনাে আঘাত পায় না; তাহা হইলেও উহা দেওয়ালই থাকে। নিতান্ত অনুভূতিহীন দেওয়াল হওয়া অপেক্ষা কোন কিছুর প্রতি আসক্তি বা আকর্ষণ অনুভব করা বরং ভাল।
যে কখনাে কাহাকেও ভালবাসে না, যে কঠিন হৃদয় ও পাষাণল্য, সে জীবনের অধিকাংশ দুঃখ এড়াইবার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ হইতেও বঞ্চিত হয়। এইরূপ অবস্থা আমরা কামনা করি না। ইহা দুর্বলতা, ইহা মতলা। যে হৃদয় কখনো দুর্বলতা অনুভব করে না, দুঃখ অনুভব করে না, সে হদয় কখনই জাগ্রত হয় নাই। তাহা স্প+নহীন জড়াবস্থা ; এরপ
অবস্থা আমরা চাই না। এইসঙ্গে কেবল প্রেমের এই মহাশক্তি, আসক্তির এই প্রবল আকর্ষণ।
একটিমাত্র বস্তুর উপর সমগ্র মনঃপ্রাণ ঢালিয়া দিয়া নিজ সত্তাকে যেন অপরের জন্য নিশেষ করিয়া দেওয়ার শক্তি যাহা দেবতাদেরই
শক্তি আমাদের কাম্য নয় ; পরন্তু আমরা দেবগণ অপেক্ষাও উচ্চতর, মহত্তর সমাহিত করিতে পারিলেও অনাসক্তই থাকেন। এই অবস্থা কিরূপে আসে? আর এই এও বহসাই আমাদের শিক্ষা করিতে হইবে। হইতে চাই। পূর্ণজ্ঞানী প্রেমের সেই একটি বিন্দুতে নিজের সমগ্র চিত্ত ভিক্ষুক কখনাে সুখী হয় না। সে যৎকিঞ্চিৎ ভিক্ষা পায়, কিন্তু ইহার পাতে থাকে করুণা ও মৃণা ; ভিক্ষুক যে নী ব্যক্তি, অস্তুতঃ এইরূপ যথাছরিপে উপভােগ করিতে পারে না। মনােভাব দানের পশ্চাতে থাকিয়া যায়। যাহা সে পায়, তাহা কখনাে
আমরা সকলেই ভিক্ষুক। আমরা যাহাই করি, তাহারই একটা প্রতিদান চাই। আমরা সকলেই জীবন ও ধর্ম লইয়া ব্যবসা করি! হায়, আমরা প্রেম লইয়াও ব্যবসা করি তােমরা যদি ব্যবসা করিতে আসিয়া থাক, আদান-প্রদান ক্রয়-বিক্রয়ের প্রশ্নই যদি তােমাদের প্রধান হইয়া থাকে, তাহা হইলে ক্রয়-বিক্রয়ের নাতি অনুসরণ কর। ব্যবসাক্ষেত্রে ভাল সময় আছে, মন্দ সময়ও আছে, মূল্যের উথান-পতনও আছে, সব সমায়ে আঘাতের আশঙ্কাও আছে। ব্যাপারটি দর্পণ
মুখ দেখার মতাে; তােমার মুখ প্রতিবিম্বিত হইল। মুখভঙ্গি কর, দর্পণে এ মুখভঙ্গি দেখা যাইবে; তুমি যদি হাস, দর্পণও হাসিবে তাহাতে হাসি
প্রতিবিম্বিত হইবে। ইহাই ক্রয়-বিক্রয়, ইহাই আদান-প্রদান। আমরা আবদ্ধ হইয়া পড়ি। কি প্রকারে আবদ্ধ হইয়া পড়ি? যাহা দিই তাহার জন্য নয়, পর যাহা আশা করি তাহার জন্যই। প্রেমের প্রতিদানে পাই আমরা দুঃখ-ভালবাসি বলিয়া নয়, পর' প্রতিদানে ভালবাসা চাই বলিয়া। আকাক্ষা যেখানে নাই, দুঃখ সেখানে থাকে না। বাসনা অভাববােধই সকল দুঃখের মূল। সফলতা ও বিফলতার নিয়মে বাসনাসমূহ আবদ্ধ। বাসনা অবশ্যই দুঃখ আনিবে।।
সুতরাং প্রকৃত সফলতা, প্রকৃত সুখের শ্রেষ্ঠ রহস্য এইঃ যিনি প্রতিদান চান না যিনি সম্পূর্ণভাবে নিঃস্বার্থ, তিনিই সর্বাধিক কৃতকার্য
কথাটি হেঁয়ালি বলিয়া মনে হয়। আমরা কি জানি না প্রত্যেক নিঃস্বার্থ ব্যক্তি জীবনে প্রতারিত হন, আঘাতপ্রাপ্ত হন আপাততঃ তাহাই বটে। 'যীশুখ্রীস্ট নিঃস্বার্থ ছিলেন, তথাপি খুশবিদ্ধ হইয়াছিলেন' সতা বটে, কিন্তু আমরা
জানি যে, এক মহান বিজয়ের কোটি কোটি মানুষের জীবনকে প্রকৃত সাফলের কল্যাণে মণ্ডিত করিবার জনাই তাহার এই নিঃস্বার্থপরত।।
কিছুই আকাক্ষা করিও না ; প্রতিদানে কিছুই চাহিও না। যাহা তোমার দিবার আছে দাও; ইহা তােমার নিকট ফিরিয়া আসিবে, কিন্তু সে বিষয়
ইহার উপর মনােনিবেশ মােটেই করিবে না। দানের শক্তি লাভ কর; দাও  এখন চিন্তা করিও না। সহস্রগুণ বর্ধিত হইয়া ইহা ফিরিয়া আসিবে, কিন্তু ব্যস, সেখানেই শেষ। শিক্ষা কর দান করিবার জন্যই এ জীবন, প্রকৃতি তােমাকে দান করিতে বাধ্য করিবে; সুতরাং স্বেচ্ছায় দান কর। শীঘ্রই হউক আর বিলম্বেই হউক, তোমাকে ত্যাগ করিতেই হইবে যাহা দেয়, তাহা দিতেই হইবে। তুমি এই সংসারে আস সঞ্চয় করিবার জন্য। মুষ্টি বন্ধ করিয়া । তুমি গ্রহণ করিতে চাও; কিন্তু প্রকৃতি তােমার গলা টিপিয়া তােমাকে দান করিতে বাধ্য করে। তােমার ইচ্ছা থাকুক বা না থাকুক, তােমাকে দিতেই হইবে। যে মুহূর্তে তুমি বলিবে, 'আমি দিব না, সেই মুহর্তেই আঘাত আসিয়া তােমাকে দুঃখ দিবে। এমন কেহই নাই, যে পরিণামে সর্বস্ব ত্যাগ করিতে বাধ্য না হইবে। এই নিয়মের বিরুদ্ধে যে যত বেশি সংগ্রাম করিবে, সে তত বেশি দুঃখ অনুভব করিবে। আমরা ত্যাগ করিতে সাহস করি না বলিয়াই, প্রকৃতির এই বিরাট দাবি বিনীতভাবে মানিয়া লইতে স্বীকার করি না বলিয়াই দুঃখ পাই। ধর, অরণ্য লােপ পাইল, কিন্তু ইহার বুলস্বরূপ আমরা সূর্যের
উত্তাপ পাই। সূর্য সাগর হইতে জল আহরণ করিয়া বৃষ্টিধারারূপে উহা প্রত্যর্পণ করে। তুমি আদান-প্রদানের যন্ত্রস্বরূপ; তুমিও দান করিবার জন্যই গ্রহণ কর। সুতরাং প্রতিদানে কিছুই চাহিও না; যতই দান করিবে, ততই সব-কিছু তােমার নিকট ফিরিয়া আসিবে। যত শীঘ্র এই কক্ষটি বায়ুশূন্য করিবে, তত শীঘ্র ইহা বাহিরের বায়ু দ্বারা পূর্ণ হইবে; কিন্তু সমস্ত দরজা, সমস্ত ছিদ্র বন্ধ করিয়া দিলে ভিতরের বায়ু ভিতরেই থাকিবে, বাহিরের বায়ু কখনাে ভিতরে আসিবে না; ফলে ভিতরের বায়ু গতিহীন হইয়া দূষিত ও বিষাক্ত হইবে। নদী অবিরত সাগরের মধ্যে নিজেকে নিঃশেষিত করিতেছে এবং পূর্ণ হইতেছে। সাগরের মধ্যে নদীর নিমিন রুদ্ধ করিও না ; যে মুহূর্তে ইহা করিবে, সেই মুহূর্তে তুমি মৃত্যুর কবলে পড়িবে।
কার্য। এই পাছার যে কি বিপদ, তাহা নির্ণয় করতে পারিবে না। এমন কি সুতরাং ভিক্ষুক হইও না ; অনাসক্ত হও। ইহাই জীবনের সর্বাধিক দুষ্কর বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে এই পথের বাধাবিঘ্নগুলি অবগত হইয়াও যতক্ষণ নাম নে-প্রাণে অনুভব করি, ততক্ষণ ঐগুলিকে ঠিক ঠিক আমরা জানিতে পারি না। দূর হইতে একটি প্রমােদ-উদ্যানের সাধারণ দৃশ্য আমাদের নয়নগােচর হইতে পারে; কিন্তু তাহাতে কি আসে যায় যখন আমরা উদ্যানের মধ্যে থাকি, তখনই উহা কিরূপ অনুভব করি, এবং যথার্থরূপে জানিতে পারি। ও বিপর্যস্ত হই, তথাপি সকল বিপর্যয়ের মধ্যে আমাদের হৃদয়বৃওিকে সতেজ রাখিতে হইবে এই সমস্ত বিপ্ন-বিপর্যয়ের মধ্যেও আমাদের অভ্যন্তরীণ যদিও আমাদের প্রত্যেকটি প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং আমরা মর্মাহত হই, আঘাতের বিনিময়ে আঘাত করি, প্রতারণার বিনিময়ে প্রতারণা করি, দেবত্বকে দৃঢ়চিত্তে প্রকাশ করিতে হইবে। প্রকৃতি চায় আমরা প্রতিক্রিয়াশীল মিথ্যার বিনিময়ে মিথ্যার আশ্রয় লই, আমাদের সর্বশক্তি দ্বারা আঘাতের
সমুচিত উত্তর দিই। তাহা হইলে দেখা যাইতেছে, আঘাতের বদলে প্রত্যাঘাত না করিতে হইলে নিজেকে সংযত করিতে সর্বোপরি অনাসক্ত হইতে এক বিরাট দিব্যশক্তির প্রয়ােজন।
প্রতিদিন আমরা নিত্য নূতনভাবে অনাসক্ত থাকিবার জন্য দৃঢ়সঙ্কল্প হই। আমরা আমাদের অতীত ভালবাসা ও আসক্তির বিষয়গুলির দিকে তাকাই এবং অনুভব করি, উহাদের প্রত্যেকটিই আমাদের জীবন কিরূপ দুঃখময় করিয়া তুলিয়াছে। আমাদের ভালবাসার জন্যই আমরা নৈরাশ্যের। অতলগর্ভে চলিয়া গিয়াছি! বুঝিতে পারিলাম, আমরা অপরের হস্তে নিতান্ত
ক্রীতদাস ; আমাদের টানিয়া নিন্ন হইতে নিম্নতর অবস্থায় নামান হইয়াছে। আবার আমরা নূতনভাবে দৃঢ়সঙ্কল্প হইঃ এখন হইতে আমি নিজের উপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব করিব, এখন হইতে নিজেকে সংযত করিব। কিন্তু কার্যকালে একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি হয়! আবার জীব বন্ধ হইয়া পড়ে, আর বাহির।
হইতে পারে না। জীব-পক্ষী জালে আবদ্ধ পক্ষসঞ্চালন করিয়া মুক্তিলাভের চেষ্টা করিতেছে। ইহাই আমাদের জীবন! আমি জানি নিজেকে সংযত করা কত কষ্টকর! বাধাবিপত্তিগুলি প্রচণ্ড; এবং আমাদের মধ্যে শতকরা নববই জন নিরাশ ও নিরুৎসাহ হইয়া পড়ি; কালক্রমে আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুঃখবাদী হইয়া সাধুতা, প্রেম এবং জীবনে যাহা কিছু উদার ও মহৎ তাহাতে বিশ্বাস হারাই। সেইজন্য আমরা দেখিতে ক্ষমাশীল থাকেন, তাহারাই বার্ধক্যে সত্যের মুখােশ-পরা মিথ্যাচারীতে পরিণত পাই, যে-সকল ব্যক্তি জীবনের প্রথম অবস্থায় সরল, দয়ালু, অকপট ও হন।
 তাহাদের মন যেন তূপীকৃত জটিলতা হয়তাে বা তাহাদের মধ্যে। অনেকটা বাহ্য বিচক্ষণতা থাকিতে পারে, তাহারা উগ্র-মস্তিষ্ক নন; তাহারা
বিশেষ কথা বলেন না, কাহাকেও অভিশাপ দেন না, কুদ্ধও হন না; কিন্তু ক্রুদ্ধ হইতে পারাও তাহাদের পক্ষে ভাল ছিল, অভিশাপ দিতে পারাও সহস্রগুণ ভাল ছিল। তাহারা তাহা পাবেন না ; তাহাদের হৃদয়বৃত্তি স্তব্ধ, কারণ তাহাদের দেহে মৃত্যুর শীতল স্পর্শ লাগিয়াছে, তাহারা নিষ্ক্রিয়, এমন। কি অভিসম্পাত করিতেও পারেন না, একটি কর্কশ কথাও বলিতে পারেন না।
এ-সবের হাত হইতে আমাদের নিষ্কৃতি পাইতে হইবে। তাই বলি আমাদের অসাধারণ ঐশী শক্তি প্রয়ােজন। সাধারণ অলৌকিক ক্ষমতা যথেষ্ট
নয়, অসাধারণ ঐশী শক্তিই একমাত্র উপায় মুক্তির একমাত্র পথ। একমাত্র ইহারই সাহায্যে আমরা সব জটিলতা অতিক্রম করিতে পারি অক্ষতদেহে অজস্র দুঃখরাশি উত্তীর্ণ হইতে পারি। আমরা খণ্ড-বিখণ্ড হইতে পারি, শতধা বিচ্ছিন্ন হইতে পারি ; তথাপি এই শক্তির সহায়তায় আমাদের হৃদয়বৃত্তি সর্বদাই মহৎ হইতে মহত্তর হইয়া উঠিবে। ইহা খুবই কঠিন, কিন্তু নিরন্তর অভ্যাস দ্বারা আমরা ইহা অতিক্রম করিতে
পারি। আমাদের বুঝিতে হইবে আমাদের কোন বিপদই ঘটিতে পারে না, যে পন্তি না আমরা নিজদিগকে উহার অনুকুল ক্ষেত্রে পরিণত করি! এইমাত্র বলিয়াছি, যতক্ষণ দেহ রােগের জন্য প্রস্তুত না হয়, ততক্ষণ কোন রােগ কাছে আসিতে পারে না; রােগ কেবল জীবাণুর উপর নির্ভর করে না, পরন্তু দেহস্থ রােগপ্রবণতার উপরও নির্ভর করে। আমরা যাহা পাইবার যােগ্য,
তাহাই পাইয়া থাকি। অহঙ্কার ত্যাগ করিয়া ইহাই যেন আমরা উপলব্ধি করি সঙ্গত কারণ ছাড়া কেহ কখনাে দুঃখগ্রস্ত হয় না। কখনাে কোন আঘাত অকারণে আসে নাই ; কখনাে এমন কোন অকল্যাণ সংঘটিত হয় নাই, যাহার জন্য আমি নিজহস্তে পথ প্রস্তুত করি নাই। ইহাই আমাদের জানিতে হইবে। তাহার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করিয়াছিলে বলিয়াই তাহা তােমাদের নিকট
নিজেদের বিশ্লেষণ করিলে দেখিতে পাইবে, যে-কোন আঘাত পাইয়াছ, উপস্থিত হইয়াছিল। তোমরা করিয়াছ অর্ধেক প্রতি, বাকি অর্ধ করিয়াছে বহির্জগৎ এইপ্রকারেই আঘাত আসিয়াছিল। এই উপলব্ধিই আমাদিগকে শান্ত করিবে।
 একই সঙ্গে এই বিশ্লেষণ হইতেই একটি আশার বাণী আসিবে এবং সেই আশার বাণী এইরূপ  বাহ্য প্রকৃতির উপর আমার কোন প্রভাব নাই। ' প্রয়ােজন হয়, আমাকে আঘাত দিতে যদি উভয়েরই আবশ্যক হয়, তাহা কিন্তু যাহা আমার ভিতরে, যাহা আমার নিকটতর, অর্থাৎ আমার নিজস্ব জগৎ, তাহা আমার নিয়ন্ত্রণাধীন। জীবনে ব্যর্থতা ঘটাইতে যদি উভয়েরই হইলে এই দুইটির মাধাে যাহা আমার হাতে, তাহা আমি ছাড়িয়া দিব না ; এক্ষেত্রে কেমন করিয়া আঘাত আসিতে পারে আমি যদি নিজের যথার্থ প্রভাব বিস্তার করিতে পারি, তাহা হইলে আঘাত কখনই আসিবে না। চেষ্টা করিতেছি। আমরা সর্বদাই পরকে সংশােধন করিতে প্রস্তুত, কিন্তু শৈশব হইতে সর্বদাই আমরা বাহিরে কোন বস্তুর উপর দোষারোপ করিতে নিজেদের সংশােধন করিতে প্রস্তুত নই। দুর্দশায় পড়িলে আমরা বলি, “হায়
এ জগৎ দানবের রাজ্য। আমরা অন্য লােককে অভিশাপ দিয়া বলি, “কি অজ্ঞনমােহে আচ্ছন্ন মুখের দল!' কিন্তু আমরা নিজেরা যদি প্রকৃতই এত সৎ হই, তবে কেন এরূপ জগতে আছি এ জগৎ যদি শয়তানের রাজ্য হয়, তবে আমরাও দানব ; নতুবা কেন আমরা এ জগতে থাকিব? ‘হায় এ জগতের লােকগুলি এত স্বার্থপর!' এ কথা সত্য, কিন্তু আমরা যদি তাহাদের চেয়ে ভাল হই, তবে তাহাদের সঙ্গে কেন আমরা বাস করিব? এই বিষয় চিন্তা করিয়া দেখ। যেটুকুর যােগ্যতা আমাদের আছে, সেইটুকুই আমরা পাইয়া থাকি। একথা বলা মিথ্যা যে, এগিং অসৎ আর আমরা কেবল সং। ইহা কখনই হইতে পারে না; এইরাপ আমরা বলিয়া আসিতেছি, কিন্তু ইহা সত্যের প্রচণ্ড অপলাপ। সর্বাগ্রে ইহাই শিক্ষণীয় বাহিরের কোন কিছুকে অভিসম্পাত না দিতে অথবা কাহারও উপর দোষারােপ না করিতে বদ্ধপরিকর হও। মানুষ হও, উঠিয়া দাড়াও, নিজের উপর দোষারােপ কর। দেখিবে ইহাই সর্বদা সত্য পথ। নিজেকে বশে আন। ইহা কি লজ্জার বিষয় নয় যে, কখনাে কখনাে নিজেদের মনুষ্যত্ব সম্বন্ধে কত বড় বড় কথা বলি, বলিয়া থাকি আমরা দেবস্বাপ, ঘােষণা করি আমরা সব কিছুই জানি, আমরা সব কিছুই করিতে পারি, আমরা নির্দোষ, নিষ্কলঙ্ক, আমাদিগকে কষ্ট দেয় ; কোন সাধারণ ব্যক্তির অঙ্গ ক্রোধও আমাদিগকে পীড়া জগতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা নিঃস্বার্থ; আবার পরমুহূর্তে একটি ক্ষুদ্র প্রস্তরখণ্ড দেয় পথের যে-কোন নির্বোধ ব্যক্তিও এইসব দেবতাদের জীবন দুঃখময় করিয়া তােলে! আমরা যদি সত্যই দেবস্বরূপ হই, তাহা হইলে কি আমাদের এইরূপ দুরবস্থা হওয়া উচিত? বাহ্য জগৎই আমাদের দুঃখ-দুর্দশার জন্য দায়ী এইরূপ অভিযােগ কি সত্য? যে ঈশ্বর শুদ্ধ, অপাপবিদ্ধ, তিনি কি আমাদের কোন ছল-চাতুরী দ্বারা দুঃখগ্রস্ত হইতে পারেন তােমরা যদি যথার্থ নিঃস্বার্থ হও, তাহা হইলে বলিতে হইবে তােমরা ঈশ্বরতুল্য।
কর্মযােগ প্রসঙ্গ : কর্ম বা কার্য ও তাহার রহস্য :Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History
Swami Vivekananda
কোন বহির্জগৎ তােমাদিগের উপর আঘাত হানিতে পারে তােমরা অক্ষতদেহে সপ্তম নরকও অতিক্রম করিতে পারি, কিছুই তোমাদিগকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ
করিতে পারিবে না। কিন্তু তােমরা যে অভিযােগ কর, বহিঃপ্রকৃতির উপর দোষারােপ কর তাহাই প্রমাণ করে যে, তােমরা বহিঃপ্রকৃতি সম্বন্ধে সচেতন এবং তোমাদের এরূপ অনুভূতি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, নিজের স্বরূপ ও মহত্ত্ব সম্বন্ধে তোমরা যা দাবি কর, বস্তুতঃ তোমরা তাহা নয়। দুঃখের উপর। দুঃখ ভূপীকৃত করিয়া, কেবল বহিঃপ্রকৃতি তােমাদিগকে আঘাত হানিতেছে
এইরূপ কল্পনা করিয়া এবং হায়! কি ভীষণ শয়তানের জগৎ!' ‘লােকটি আমাকে আঘাত করতেছে, ঐ ব্যক্তি আমাকে কষ্ট দিচ্ছে' ইত্যাদি চিৎকার করিয়া তােমরা নিজেদের অপরাধ, দুঃখ-দুর্দশা বাড়াইয়া তুলিতেছ। একে তাে। দুঃখ পাইছি, তদুপরি মিথ্যা আরোপ করবে কিছুকালের জন্য অন্যের কথা ছাড়িয়া দিয়া আমাদের নিজেদের বিষয়ে সতর্ক হতে হবে; এইটুকু আমরা নিশ্চয়ই করিতে পারি। এস, আমরা কর্মের উপায়গুলি নিখুঁত করিয়া তুলি ; তাহা হইলে উদ্দেশ্য ও স্বতই ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের জীবন যদি মহৎ ও পবিত্র হয়, তবে এ জগৎ মহৎ ও পবিত্র হইতে পারে। জগৎ কার্য-স্বরূপ, আমরা কারণ-স্বরূপ। সুতরাং এস, আমরা নিজেদের নিষ্কলুষ ও পূর্ণ করিয়া তুলি।

কর্মযােগ প্রসঙ্গ দ্বিতীয় পর্ব   

Life History......................... 

1 comment:

  1. Nice article on swami vivekananda 's lifehttps://www.hindisuvichaar.in/2020/03/motivational-poem-hindi.html"> for motivational poem in Hindi you can click on link

    ReplyDelete

Powered by Blogger.