কর্মযোগের আদর্শ Swami Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History

কর্মযোগের আদর্শ Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History 
কর্মযোগের আদর্শ Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History
Swami Vivekananda

বেদান্ত-ধর্মের মহান ভাব এই যে, আমরা বিভিন্ন পথে সেই একই চরম লক্ষ্যে উপনীত হতে পারে। এই পথগুলো আমি চারটি বিভিন্ন উপায় রূপে সংক্ষেপে বর্ণনা করিয়া থাকি কর্ম, ভক্তি, যােগজ্ঞান। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের যেন মনে থাকে যে এই বিভাগ খুব ধরাবাধা নয়, অত্যন্ত পৃথক নয়। প্রত্যেকটিই অপরটি সহিত মিশিয়া যায় ; তবে প্রাধান্য অনুসারে এই বিভাগ। এমন লোক বাহির করতে পারবে না, কর্ম করার শক্তি ব্যতীত যাহার অন্য কোন শক্তি নাই, যে শুধু ভক্ত ছাড়া আর কিছু নয়, অথবা যাহার শুধু ছাড়া আর কিছু নাই। বিভাগ কেবল মানুষের গুণ বা প্রবণতার
প্রাধান্যে। আমরা দেখিয়াছি, শেষ পর্যন্ত এই চারিটি পথ একই ভাবের অভিমুখী হইয়া মিলিত হয়। সকল ধর্ম এবং সাধন প্রণালীই আমাদিগকে সেই এক চরম লক্ষ্যে লইয়া যায়।
সেই চরম লক্ষ্যটি কি, তাহা বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছি। আমি যেরূপ বুঝিয়াছি—ঐ লক্ষ্য মুক্তি। যাহা কিছু আমরা দেখি বা অনুভব করি, পরমাণু হইতে মনুষ্য, অচেতন প্রাণহীন জড়কণা হইতে পৃথিবীতে বিদ্যমান সর্বোচ্চ সত্তা—মানবাত্মা পর্যন্ত সকলেই মুক্তির জন্য চেষ্টা করিতেছে। সমগ্র জগৎ এই মুক্তির সংগ্রাম বা চেষ্টার ফল। সকল যৌগিক পদার্থের প্রত্যেক পরমাণুই অন্যান্য পরমাণুর বন্ধন হইতে মুক্ত হইতে চেষ্টা করিতেছে এবং অপরগুলি উহাকে আবদ্ধ করিয়া রাখিতেছে। আমাদের পৃথিবী সূর্যের নিকট হইতে এবং চন্দ্র পৃথিবীর নিকট হইতে দূরে যাইতে চেষ্টা করিতেছে। প্রত্যেক পদার্থই অনন্ত বিস্তারের জন্য উন্মুখ। আমরা জগতে যা-কিছু পদার্থ দেখিতেছি, এই জগতে যত কার্য বা চিন্তা আছে, সব-কিছুর একমাত্র ভিত্তি—এই মুক্তির চেষ্টা। ইহারই প্রেরণায় সাধু উপাসনা করেন এবং চোর চুরি করে। যখন কর্ম প্রণালী যথাযথ হয় না, তখন আমরা তাহাকে মন্দ বলি, এবং যখন কর্মপ্রণালীর প্রকাশ যথাযথ ও উচ্চতর হয়, তখন তাহাকে ভাল বলি। কিন্তু প্রেরণা উভয়ত্ৰ সমান—সেই মুক্তির চেষ্টা। সাধু নিজের বন্ধনের বিষয়।
ভাবিয়া কষ্ট পান; তিনি বন্ধন হইতে মুক্তি পাইতে চান, সেজন্য ঈশ্বরের উপাসনা করেন। চোরও এই ভাবিয়া কষ্ট পায় যে, তাহার কতকগুলি বস্তুর
চেতন, অচেতন সমুদয় প্রকৃতির লক্ষ্য এই মুক্তি। জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে অভাব; সে এ অভাব হইতে মুক্ত হইতে চায় এবং সেইজন্য চুরি করে।
সমগ্র জগৎ ঐ মুক্তির জন্য চেষ্টা করিয়া চলিয়াছে। অবশ্য সাধুর ঈপ্সিত মুক্তি চোরের বাঞ্ছিত মুক্তি হইতে সম্পূর্ণরূপে পৃথক। সাধু মুক্তির চেষ্টায় কার্য উপর বন্ধন বাড়িতে থাকে। করিয়া অনন্ত অনির্বচনীয় আনন্দ লাভ করেন, কিন্তু চোরের কেবল বন্ধনের প্রত্যেক ধর্মেই মুক্তির জন্য প্রাণপণ চেষ্টার বিকাশ আমরা দেখিতে পাই। ইহা সমুদয় নীতি ও নিঃস্বার্থপরতার ভিত্তি। নিঃস্বার্থপরতার অর্থঃ “আমি এই ক্ষুদ্র শরীর’—এইভাব হইতে মুক্ত হওয়া। যখন আমরা দেখিতে পাই, কোন
লােক ভাল কাজ করিতেছে, পরােপকার করিতেছে, তখন বুঝিতে হইবে সেই ব্যক্তি ‘আমি ও আমার’-রূপ ক্ষুদ্র বৃত্তের ভিতর আবদ্ধ থাকিতে চায় না। এই স্বার্থপরতার গণ্ডির বাহিরে যাওয়ার কোন সীমা নাই। চরম স্বার্থত্যাগ সকল বড় বড় নীতিশাস্ত্রেই লক্ষ্য বলিয়া প্রচারিত। মনে কর, একজন এই চরম স্বার্থত্যাগের অবস্থা লাভ করিল, তখন তাহার কি হইবে? তখন সে আর ছােটখাট শ্ৰীঅমুকচন্দ্র অমুক থাকে না; সে তখন অনন্ত বিস্তার লাভ করে। পূর্বে তাহার যে ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্ব ছিল, তাহা একেবারে চলিয়া যায়। সে তখন অনন্ত-স্বরূপ হইয়া যায়। এই অনন্ত বিস্তৃতিই সকল ধর্মের, সকল নীতি শিক্ষারও দর্শনের লক্ষ্য। ব্যক্তিত্ববাদী যখন এই তত্ত্বটি দার্শনিকভাবে উপস্থাপিত। দেখেন, তখন ভয়ে শিহরিয়া ওঠেন। নীতি প্রচার করিতে গিয়া তিনি নিজেই আবার সেই একই তত্ত্ব প্রচার করেন। তিনিও মানুষের নিঃস্বার্থপরতার কোন সীমা নির্দেশ করেন না। মনে কর, এই ব্যক্তিত্ববাদমতে এক ব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বাথশূন্য হইলেন। তাহাকে তখন অপরাপর সম্প্রদায়ের পূর্ণ-সিদ্ধ ব্যক্তি হইতে পৃথক করিয়া দেখি কি করিয়া তিনি তখন সারা বিশ্বের সহিত এক হইয়া যান; এইরূপ হওয়াই তাে চরম লক্ষ্য। হতভাগ্য ব্যক্তিত্ববাদী তাহার নিজের কর্মদ্বারা মানব-প্রকৃতির চরম লক্ষ্য এই মুক্তিলাভ করাই কর্মযােগ। সুতরাং ।
যুক্তিগুলিকে যথার্থ সিদ্ধান্ত পর্যন্ত অনুসরণ করিবার সাহস পায় না। নিঃস্বার্থ। প্রত্যেক স্বার্থপুর্ণ কার্যই আমাদের সেই লক্ষ্যে পৌছিবার পথে বাধাস্বরূপ, আর প্রত্যেক নিঃস্বার্থ কর্মই আমাদিগকে সেই লক্ষ্যের দিকে লইয়া যায়।
এইজন্য নীতির এই একমাত্র সংজ্ঞা ও যাহা স্বার্থশূন্য, তাহাই নাতিসঙ্গত; আর যাহা স্বার্থপর, তাহা নীতিবিরুদ্ধ। খুঁটিনাটির মধ্যে প্রবেশ করিলে ব্যাপারটি এত সহজ দেখাইবে না। অবস্থাভেদে খুঁটিনাটি কর্তব্য ভিন্ন ভিন্ন হইবে, একথা পূর্বেই বলিয়াছি। একই কার্য এক ক্ষেত্রে স্বার্থশূিনা এবং অপর ক্ষেত্রে সত্যই স্বার্থপ্রণােদিত হইতে পারে। সুতরাং আমরা কেবল কর্তব্যের একটি সাধারণ সংজ্ঞা দিতে পারি বিশেষ বিশেষ কর্তব্য অবশ্য দেশ-কাল-পাত্র বিবেচনা করিয়া নিরূপিত হইবে। এক দেশে একপ্রকার আচরণ নীতিসঙ্গত বলিয়া বিবেচিত হয়। অপর দেশে আবার তাহাই অতিশয় নীতিবিগর্হিত বলিয়া গণ্য হইয়া থাকে। ইহার কারণ। পরিবেশ পৃথক। সমুদয় প্রকৃতির চরম লক্ষ্য মুক্তি, আর এই মুক্তি কেবল পূর্ণ নিঃস্বার্থপরতা হইতেই লাভ করা হয়। আর প্রত্যেক স্বার্থশূন্য কার্য, প্রত্যেক নিঃস্বার্থ চিন্তা, প্রত্যেক নিঃস্বার্থ বাক্য আমাদিগকে ঐ আদর্শের অভিমুখে লইয়া যায় সেইজনাই ঐ কার্যকে নীতিসঙ্গত বলা হয়। ক্রমশঃ বুঝিবে এই সংজ্ঞাটি সকল ধর্ম এবং সকল নীতিশাস্ত্র-সম্বন্ধেই খাটে।
নীতিতত্ত্বের মূলসম্বন্ধে অবশ্য বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধারণা থাকিতে পারে। কোন কোন প্রণালীতে নীতি কোন উন্নততর পুরুষ অর্থাৎ ভগবান হইতে প্রাপ্ত বলিয়া উল্লিখিত। যদি জিজ্ঞাসা কর, 'মানুষ কেন এ-কাজ করিবে এবং ও-কাজ করিবে না ?' উত্তরে এ সকল সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগণ বলিবেন ইহাই ঈশ্বরের আদেশ” কিন্তু যেখান হইতেই তাহারা ইহা পাইয়া থাকুন না কেন,
তাহাদের নীতিতত্ত্বের মূল কথা—নিজের চিন্তা না করা, ‘অহং’কে ত্যাগ করা। এই প্রকার উচ্চ নীতিতত্ত্ব সত্ত্বেও অনেকে তাহাদের ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্ব ত্যাগ করিতে ভয় পান। যে ব্যক্তি এইরূপে ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্বের ভাব আঁকড়াইয়া থাকিতে চায়, তাহাকে বলিতে পারি, এমন একজনের চিন্তা কর, যে সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ যাহার নিজের জন্য কোন চিন্তা নাই, যে নিজের জন্য কিছু করে না, যে নিজের পক্ষে কোন কথা বলে না; এখন বল দেখি, তাহার 'নিজত্ব কোথায় যতক্ষণ সে নিজের জন্য চিন্তা করে, কাজ করে বা কথা বলে, ততক্ষণই সে তাহার ‘নিজেকে' বােধ করে। সে যদি কেবল অপরের সম্বন্ধে জগতের সকলের সম্বন্ধে সচেতন থাকে, তাহা হইলে তাহার নিজত্ব কোথায় তাহার নিজত্ব' তখন একেবারে লােপ পাইয়াছে।
অতএব কর্মযােগ নিঃস্বার্থপরতা ও সৎকর্ম দ্বারা মুক্তি লাভ করিবার একটি ধর্ম ও নীতিপ্রণালী। কর্মযােগীর কোন প্রকার ধর্মমতে বিশ্বাস করিবার
অনুসন্ধান না করিতে পারেন, অথবা কোন প্রকার দার্শনিক বিচারও না আবশ্যকতা নাই। তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস না করিতে পারেন, সম্বন্ধে
করিতে পারেন, কিছুই আসে যায় না। তাহার বিশেষ উদ্দেশ্য নিঃস্বার্থপরতা লাভ করা এবং তাহাকে নিজ চেষ্টাতেই উহা লাভ করিতে হইবে। তাহার জীবনের প্রতি মুহূর্তই হইবে উহার উপলব্ধি, কারণ জ্ঞানী যুক্তি-বিচার করিয়া বা ভক্ত ভক্তির দ্বারা যে সমস্যা সমাধান করিতেছেন, তাহাকে কোনপ্রকার। মতবাদের সহায়তা না লইয়া কেবল কর্ম দ্বারা সেই সমস্যারই সমাধান
করিতে হইবে। এখন পরবর্তী প্রশ্নঃ এই কর্ম কি? 'জগতের উপকার করা’-রাপ এই ব্যাপারটি কি আমরা কি জগতের কোন উপকার করিতে পারি উচ্চতম দৃষ্টি হইতে বলিলে বলিতে হইবে ‘না’ ; কিন্তু আপেক্ষিকভাবে ধরিলে ‘ই’ বলিতে হইবে। জগতের কোন চিরস্থায়ী উপকার করা যাইতে পারে না; তাহা যদি করা যাইত, তাহা হইলে ইহা আর এই জগৎ থাকিত না। আমরা পাচ
মিনিটের জন্য কোন ব্যক্তির ক্ষুধা নিবৃত্ত করিতে পারি, কিন্তু সে আবার ক্ষুধার্ত হইবে। আমরা মানুষকে যাহা কিছু সুখ দিতে পারি, তাহা ক্ষণস্থায়ী। মাত্র। কেহই এই নিত্য আবর্তনশীল সুখ-দুঃখরাশি একেবারে চিরকালের জন্য।
দূর করিতে পারে না। জগতে কি কাহাকেও কোন নিত্য সুখ দেওয়া যাইতে। পারে? না, তাহা দেওয়া যাইতে পারে না। সমুদ্রের কোথাও গহ্বর সৃষ্টি না।
করিয়া একটি তরঙ্গও তুলিতে পারা যায় না। মানুষের প্রয়ােজন ও লােভের অনুপাতে জগতে ভালর সমষ্টি বরাবর একই প্রকার, সর্বদাই সমান। উহা বাড়ান বা কমান যায় না। বর্তমানকাল পর্যন্ত পরিজ্ঞাত মনুষ্যজাতির ইতিহাস আলােচনা কর। সেই পূর্বের মতােই সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, পদমর্যাদার তারতম্য দেখিতে পাই না কি কেহ ধনী, কেহ দরিদ্র ; কেহ উচ্চপদস্থ, কেহ নিম্নপদস্থ ; কেহ সুস্থ, কেহ বা অসুস্থতাই নয় কি প্রাচীন মিশরবাসী, গ্রীক ও রােমানদের যে অবস্থা ছিল, আধুনিক আমেরিকানদেরও সেই এক অবস্থা। জগতের ইতিহাস যতটা জানা যায়, তাহাতে দেখিতে পাই, মানুষের অবস্থা
বরাবর একই প্রকার ; তথাপি আবার ইহাও দেখিতে পাই, সুখ-দুঃখের এই দুরপনেয় বৈষম্যের সঙ্গে সঙ্গে ঐগুলি দূর করিবার চেষ্টাও বরাবর রহিয়াছে। ইতিহাসের প্রত্যেক যুগেই এমন সহস্র সহস্র নরনারী জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, যাহারা অপরের জীবনের পথ সহজ করিবার জন্য কঠোরভাবে কাজ করিয়াছেন; তাহারা কতদূর কৃতকার্য হইয়াছেন আমরা একটি বলকে (ball) একস্থান হইতে আর একস্থানে লইয়া যাওয়া কাপ খেলাই খেলিতে। পারি। আমরা শরীর হইতে দুঃখবেদনা দূর করিলাম, উহা মনে আশ্রয় লইল।। ইহা ঠিক দান্তের (Dante) সেই নরক-চিত্রের মতাে পাহাড়ের উপর ঠেলিয়া তুলিবার জন্য কৃপণদিগকে রাশীকৃত সুবর্ণ দেওয়া হইয়াছে। যতবার তাহারা একটু ঠেলিয়া তুলিতেছে, ততবারই উহা গড়াইয়া নিচে পড়িতেছে। সুখের স্বর্ণযুগ (millenium) সম্বন্ধে যে-সকল কথা বলা হয় সে সবই স্কুলের ছেলেদের উপযােগী সুন্দর গল্প, তদপেক্ষা ভাল কিছু নয়। যে সকল জাতি এই সুখের স্বর্ণযুগের স্বপ্ন দেখে, তাহারা আবার এরূপও ভাবিয়া থাকে খ্রীস্টধর্ম ঠিক এই গোড়ামির মােহ দ্বারাই প্রচারিত হইয়াছিল, ইহারই জন্য গ্রীক ও রােমক ক্রীতদাসগণ এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিল। তাহারা। বিশ্বাস করিয়াছিল এই ধর্মে তাহাদিগকে আর দাসত্ব করিতে হইবে না, তাহারা যথেষ্ট খাইতে পরিতে পাইবে; সেইজন্যই তাহারা খ্রীস্টধর্মের পতাকাতলে সমবেত হইয়াছিল। প্রথমে যাহারা উহা প্রচার করিয়াছিল,
তাহারা অবশ্য গোড়া অজ্ঞ ছিল, কিন্তু তাহারা প্রাণের সহিত ঐসব কথা বিশ্বাস করিত। বর্তমানকালে এই স্বর্ণযুগের আকাক্ষা সাম্য, স্বাধীনতা ও প্রাতৃত্বের আকার ধারণ করিয়াছে। ইহাও গোড়ামি। যথার্থ সাম্যভাব জগতে এখনাে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই এবং কখনাে হইতেও পারে না। এখানে কি করিয়া আমরা সকলে সমান হইব? এই অসম্ভব ধরনের সাম্য বলিতে সমষ্টি বিনাশই বুঝায়। জগতের এই যে বর্তমান রূপ, তাহার কারণ কি? সাম্যের অভাব।
জগতের আদিম অবস্থায় সৃষ্টির পূর্বে সম্পূর্ণ সাম্যভাব থাকে। তবে বিশ্বগঠনকারী বিভিন্ন শক্তির উদ্ভব হয় কিরূপে ? বিরােধ, সংগ্রাম ও
প্রতিদ্বন্দ্বিতা দ্বারা। মনে কর, পদার্থের পরমাণুগুলি সব সম্পূর্ণ সাম্যাবস্থায় আছে, তাহা হইলে কি সৃষ্টিকার্য চলিতে থাকিবে বিজ্ঞানের সাহায্যে জানি, ইহা অসম্ভব জলাশয়ের জল নাড়িয়া দাও, দেখিবে প্রত্যেক অলবিন্দু আবার শান্ত হইবার চেষ্টা করিতেছে, একটি আর একটির দিকে প্রবাহিত হইতেছে। এই একইভাবে “বিশ্বজগৎ" বলিয়া কথিত এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রপঞ্চ ইহার অন্তর্গত সকল পদার্থইি তাহাদের পূর্ণ সাম্যভাবে ফিরিয়া যাইতে চেষ্টা করিতেছে। আবার বিক্ষোভ দেখা দেয়, আবার সংযােগ হয়—সৃষ্টি হয়। বৈষম্যই সৃষ্টির ভিত্তি। সৃষ্টির জন্য সাম্যভাব-বিনাশকারী শক্তির যতটা প্রয়ােজন, সঙ্গে সঙ্গে সামভাবস্থাপনকারী শক্তিরও ততটা প্রয়ােজন। সম্পূর্ণ সাম্যভাব যাহার অর্থ সর্বস্তরে সংগ্রামশীল শক্তিগুলির পূর্ণ সামঞ্জস্য, তাহা এ জগতে কখনই হইতে পারে না। এই অবস্থায় উপনীত হইবার পূর্বেই জগৎ জীব-বাসের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত হইয়া যাইবে, এখানে আর সাম্যভাব-সম্বন্ধে ধারণাসমূহ শুধু যে অসম্ভব তাহা নহে, পরন্তু যদি আমরা ঐ কেহই থাকিবে না। অতএব আমরা দেখিতেছি, এই স্বর্ণযুগ বা পূর্ণ ধারণাগুলি কার্যে পরিণত করিতে চেষ্টা করি, তবে নিশ্চয়ই সেই প্রলয়ের দিন ঘনাইয়া আসিবে। মানুষে মানুষে প্রভেদের কারণ কি ? প্রধানতঃ মস্তিষ্কের ভিন্নতা। আজকাল পাগল ছাড়া আর কেহই বলিবে না যে, আমরা সকলেই একরূপ মস্তিষ্কের শক্তি লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছি। ভিন্ন ভিন্ন শক্তি লইয়া আমরা জগতে আসিয়াছি। কেহ বড়, কেহ বা সামান্য হইয়া আসিয়াছি, জন্মের পূর্বে নির্ধারিত পরিবেশ অতিক্রম করা যায় না। আমেরিকার রেড-ইণ্ডিয়ানগণ সহস্র সহস্র বৎসর যাবৎ এই দেশে বাস করিতেছিল, আর তােমাদের অতি অল্পসংখ্যক পূর্বপুরুষ এদেশে আসিয়াছিলেন, দেশের চেহারায় তাহারা কত পরিবর্তন সাধন করিয়াছেন যদি সকলেই সমান, তবে
রেড-ইণ্ডিয়ানরা নানাপ্রকার উন্নতি এবং নগরাদি নির্মাণ করে নাই কেন? কেনই বা তাহারা চিরকাল বনে বনে শিকার করিয়া বেড়াইল তােমাদের
পূর্বপুরুষগণের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন প্রকার মস্তিষ্কশক্তি ও ভিন্ন প্রকার সংস্কারসমষ্টি আসিয়া একযােগে কাজ করিয়া নিজেদের উন্নতি করিয়াছে। আত্যন্তিক বৈষম্যশূন্যতাই মৃত্যু। যতদিন এই জগৎ থাকিবে, ততদিন বৈষম্য থাকিবে; সৃষ্টিচক্র যখন শেষ হইয়া যাইবে, তখনই পূর্ণ সাম্যভাবের স্বর্ণযুগ আসিবে। তাহার পূর্বে সাম্যভাব আসিতে পারে না। তথাপি এই ভাব আমাদের এক প্রবল প্রেরণাশক্তি। সৃষ্টির জন্য যেমন বৈষম্য প্রয়ােজন, তেমনি ঐ বৈষম্য সীমাবদ্ধ করার চেষ্টাও প্রয়ােজন। বৈষম্য না থাকিলে সৃষ্টি থাকিত না, আবার সাম্য বা মুক্তিলাভের ও ঈশ্বরের নিকট ফিরিয়া যাইবার চেষ্টা না থাকিলেও সৃষ্টি থাকিত না। এই দুই শক্তির তারতম্যেই মানুষের অভিসন্ধিগুলির প্রকৃতি নিরূপিত হয়। কর্মের এই বিভিন্ন প্রেরণা চিরকাল থাকিবে, ইহাদের কতকগুলি মানুষকে বন্ধনের দিকে এবং কতকগুলি মুক্তির দিকে চালিত করে। এই সংসার চক্রের ভিতরে চক্র' এ বড় ভয়ানক যন্ত্র। ইহাতে যদি হাত দিই, তবে আটকা পড়িলেই সর্বনাশ। আমরা সকলেই ভাবি কোন বিশেষ কর্তব্য করা হইয়া গেলেই আমরা বিশ্রাম লাভ করিব; কিন্তু ঐ কর্তব্যের কিছুটা করিবার পূর্বেই দেখি আর একটি কর্তব্য অপেক্ষা করিতেছে। এই বিশাল ও জটিল জগৎ-যন্ত্র আমাদের সকলকেই টানিয়া লইয়া যাইতেছে। ইহা হইতে বাচিবার দুইটিমাত্র উপায় আছে একটি এই যন্ত্রের সহিত
সংস্রব একেবারে ছাড়িয়া দেওয়া, উহাকে চলিতে দেওয়া এবং একধারে সরিয়া দাড়ানাে সকল বাসনা ত্যাগ করা। ইহা বলা খুব সহজ, কিন্তু করা
একপ অসম্ভব। দুই কোটি লােকের মধ্যে একজন ইহা করিতে পারে কিনা। জানি না। আর একটি উপায় এই জগতে ঝাপ দিয়া কর্মের রহস্য অবগত হওয়া ইহাকেই কর্মযােগ’ বলে। জগৎ-যন্ত্রের চক্র হইতে পলায়ন করিও না ; উহার ভিতরে থাকিয়া কর্মের রহস্য শিক্ষা কর। ভিতরে থাকিয়া যথাযথভাবে কর্ম করিয়াও এই কর্মচক্রের বাহিরে যাওয়া সম্ভব। এই যন্ত্রের
মধ্য দিয়াই ইহার বাহিরে যাইবার পথ।
আমরা এখন দেখিলাম, কর্ম কি। কর্ম প্রকৃতির ভিত্তির অংশবিশেষ কর্মপ্রবাহ সর্বদাই বহিয়া চলিয়াছে। যাহারা ঈশ্বরে বিশ্বাসী, তাহারা ইহা আরও ভালরূপে বুঝিতে পারেন, কারণ তাহারা জানেন ঈশ্বর এমন একজন অক্ষম পুরুষ নন যে, তিনি আমাদের সাহায্য চাহিবেন। যদিও এই জগৎ চিরকাল চলিতে থাকিবে, আমাদের লক্ষ্য মুক্তি, আমাদের লক্ষ্য স্বাশূিন্যতা। কর্মযােগ অনুসারে কর্মের দ্বারাই আমাদিগকে এ লক্ষ্যে উপনীত হইতে হইবে। এইজন্যই আমাদের কর্মরহস্য জানা প্রয়ােজন। জগৎকে সম্পূর্ণরূপে সুখী করিবার যাবতীয় ধারণা গোড়াদিগকে কর্মে প্রবৃত্ত করিবার পক্ষে ভালই হইতে পারে; কিন্তু আমাদের জানা উচিত যে, গোড়ামি দ্বারা ভালও যেমন হয়, মন্দও তেমনি হয়। কর্মযােগী জিজ্ঞাসা করেন, কর্ম করিবার জন্য মুক্তির সহজাত অনুরাগ ব্যতীত উদ্দেশ্যমূলক কোন প্রেরণার প্রয়ােজন কি সাধারণ উদ্দেশ্য বা অভিসন্ধির গণ্ডি অতিক্রম কর। কমেই তােমার অধিকার, ফলে নয় কর্মণ্যবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন। কর্মযােগী বলেন, মানুষ এ তত্ত্ব অবগত হইয়া অভ্যাস করিতে পারে। যখন লােকের উপকার করিবার ইচ্ছা তাহার মজ্জাগত হইয়া যাইবে, তখন আর তাহার বাহিরের কোন প্রেরণার প্রয়ােজন থাকিবে না। লােকের উপকার কেন করিব? ভাল লাগে বলিয়া। আর কোন প্রশ্ন করিও না। ভাল কাজ কর, কারণ ভাল কাজ করা ভাল। কর্মযােগী বলেন, স্বর্গে যাইবে বলিয়া যে ভাল কাজ করে, সেও যায়, তাহা মুক্তির পরিবর্তে আমাদের পায়ে আর একটি শৃঙ্খল পরাইয়া দেয়।
নিজেকে বদ্ধ করিয়া ফেলে। এতটুকু স্বার্থযুক্ত অভিসন্ধি লইয়া যে কর্ম করা যদি আমরা মনে করি, এই কর্ম দ্বারা আমরা স্বর্গে যাইব, তাহা হইলে আমরা করিতে হইবে; উহা আমাদের পক্ষে আর একটি বন্ধনস্বরূপ হইবে। স্বর্গ নামক একটি স্থানে আসক্ত হইব। আমাদিগকে স্বর্গে গিয়া স্বর্গসুখ ভােগ অতএব একমাত্র উপায় সমুদয় কর্মের ফল ত্যাগ করা, অনাসক্ত হওয়া।
এইটি জানিয়া রাখঃ জগৎ আমরা নয়, আমরাও এই জগৎ নই ; বাস্তবিক আমরা শরীরও নই, আমরা প্রকৃতপক্ষে কর্ম করি না। আমরা আত্মা
চিরস্থির, চিরশান্ত। আমরা কেন কিছুর দ্বারা বদ্ধ হইব? আমাদের রােদনেরও কোন কারণ নাই, আত্মার পক্ষে কাদিবার কিছুই নাই। এমনকি, অপরের দুঃখে সহানুভূতিসম্পন্ন হইয়াও আমাদের কাদিবার কোন প্রয়ােজন নাই। এইরূপ কান্নাকাটি ভালবাসি বলিয়াই আমরা কল্পনা করি যে, ঈশ্বর তাহার সিংহাসনে বসিয়া এইরূপে কাঁদিতেছেন। ঈশ্বর কাদিবেনই বা কেন ক্রন্দন তাে বন্ধনের চিহ্ন দুর্বলতার চিহ্ন। একবিন্দু চোখের জল যেন না পড়ে। এইরূপ হইবার উপায় কি ‘সম্পূর্ণ অনাসক্ত হও' বলা খুব ভাল বটে, কিন্তু হইবার উপায় কি অভিসন্ধিশূন্য হইয়া যে-কোন ভাল কাজ করি, তাহা আমাদের পায়ে একটি নূতন শৃঙ্খলা সৃষ্টি না করিয়া যে শৃঙ্খলে আমরা বদ্ধ রহিয়াছি, তাহারই একটি শিকলি ভাঙিয়া দেয়। আমরা প্রতিদানে কিছু পাইবার আশা না করিয়া যে-কোন সৎচিন্তা চারিদিকে প্রেরণ করি, তাহা সঞ্চিত হইয়া থাকিবে আমাদের বন্ধন-শঙ্খলের একটি শিকলি চূর্ণ করিবে, এবং আমরা ক্রমশঃই পবিত্রতর হইতে থাকিব যতদিন না পবিত্রতম মানবে পরিণত হই। কিন্তু লােকের নিকট ইহা যেন কেমন অস্বাভাবিক ও অত্যধিক দার্শনিক এবং কার্যকর অপেক্ষা বেশি তাত্ত্বিক বলিয়া বােধ হয়। আমি ভগবদ্গীতার বিরুদ্ধে
অনেক যুক্তিতর্ক পড়িয়াছি, অনেকেই বলিয়াছেন অভিসন্ধি বা উদ্দেশ্য। ব্যতীত মানুষ কাজ করিতে পারে না। ইহারা গোড়ামির প্রভাবে কৃত কর্ম ব্যতীত কোন নিঃস্বার্থ কার্য কখনাে দেখে নাই, সেইজন্যই এইরূপ বলিয়া যিনি কর্মযােগের এই শিক্ষা কার্যে পরিণত করিয়াছেন। সেই ব্যক্তি বুদ্ধদেব  একমাত্র তিনি ইহা সম্পূর্ণরূপে কার্যে পরিণত করিয়াছিলেন। বুদ্ধ ব্যতীত জগতের অন্যান্য মহাপুরুষগণের সকলেই বাহ্য (প্ররণার বশে নিঃস্বার্থ কর্মে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। কারণ এই একটি ব্যক্তি ছাড়া জগতের মহাপুরুষগণকে দুই
থাকে। উপসংহারে অল্প কথায় তােমাদের নিকট এমন এক ব্যক্তির বিষয়ে বলিব, শ্রেণীতে বিভক্ত করা যাইতে পারে  এক শ্রেণী বলেন তাহারা ঈশ্বরের অবতার, পৃথিবীতে অবতীর্ণ হইয়াছেন, অপর শ্রেণী বলেন তাহারা ঈশ্বরের প্রেরিত বার্তাবহ ; উভয়েরই কার্যের প্রেরণাশক্তি বাহির হইতে আসে ; আর যত উচ্চ আধ্যাত্মিক ভাষা ব্যবহার করুন না কেন, তাহারা বহির্জগৎ হইতেই পুরস্কার আশা করিয়া থাকেন। কিন্তু মহাপুরুষগণের মধ্যে একমাত্র বুদ্ধই বলিয়াছিলেন, 'আমি ঈশ্বর সম্বন্ধে তােমাদের ভিন্ন ভিন্ন মত শুনিতে চাই না। আত্ম সম্বন্ধে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম মতবাদ বিচার করিয়াই কি হইবে? ভাল হও এবং ভাল কাজ কর। ইহাই তােমাদের মুক্তি দিবে, এবং সত্য যাহাই হউক না, সেই সত্যে লইয়া যাইবে।
তিনি আচরণে সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগত অভিসন্ধিবর্জিত ছিলেন ; আর কোন মানুষ  তাহা অপেক্ষা বেশি কাজ করিয়াছেন ইতিহাসে এমন একটি চরিত্র। দেখাও, যিনি সকলের উপরে এত উর্ধ্বে উঠিয়াছেন! সমুদয় মনুষ্যজাতির মধ্যে এইরূপ একটিমাত্র চরিত্র উদ্ভত হইয়াছে, যেখানে এত উন্নত দর্শন ও এমন উদার সহানুভূতি! এই মহান দার্শনিক শ্রেষ্ঠ দর্শন প্রচার করিয়াছেন, আবার অতি নিম্নতম প্রাণীর জন্যও গভীরতম সহানুভূতি প্রকাশ করিয়াছেন, নিজের জন্য কিছুই দাবি করেন নাই। বাস্তবিক তিনিই আদর্শ কর্মযােগী সম্পূর্ণ অভিসন্ধিশূন্য হইয়া তিনি কাজ করিয়াছেন; মনুষ্যজাতির ইতিহাসে দেখা যাইতেছে যত মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তিনিই তাহাদের
মধ্যে শ্রেষ্ঠ! হৃদয় ও মস্তিষ্কের অপূর্ব সমাবেশ-অতুলনীয় বিকশিত আস্থাশক্তির শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। জগতে তিনিই প্রথম একজন মহান সংস্কারক।।
কর্মযোগের আদর্শ Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History
Swami Vivekananda
তিনিই প্রথম সাহসপূর্বক বলিয়াছেন, “কোন প্রাচীন পুঁথিতে কোন বিষয় লেখা আছে বলিয়া বা তােমার জাতীয় বিশ্বাস বলিয়া অথবা বাল্যকাল হইতে না বিচার করিয়া, তারপর বিশেষ বিশ্লেষণ করিয়া যদি দেখ উহা সকলের তােমাকে বিশ্বাস করিতে শেখানাে হইয়াছে বলিয়াই কোন কিছু বিশ্বাস করিও অপরকে এ উপদেশ অনুসারে জীবনযাপন করিতে সাহায্য কর।' পক্ষে উপকারী, তবেই উহা বিশ্বাস কর, ঐ উপদেশমত জীবনযাপন কর এবং যিনি অথ, যশ বা অন্য কোন অভিসন্ধি ব্যতীতই কম করেন, তিনিই সর্বাপেক্ষা ভাল কর্ম করেন। এবং মানুষ যখন এরূপ কর্ম করিতে সমর্থ
হইবে, তখন সেও একজন বুদ্ধ হইয়া যাইবে এবং তাহার ভিতর হইতে এরূপ কমশিও উৎসারিত হইবে, যাহা জগতের রূপ পরিবর্তিত করিয়া ফেলিবে। এরূপ ব্যক্তিই কর্মযােগের চরম আদর্শের দৃষ্টান্ত।

Life history more.... 


...........................Life History.........................

No comments:

Powered by Blogger.