জীবন সুত্র

জীবন সুত্র

জীবন সুত্র
কর্ম জীবন 

।। প্রথমমেই বলে রাখি আপনার হাতে সময় থাকলে পড়ুন না হলে সেভ করে রাখতে পারেন,,  পরে পুরোটা পড়ুন
তারপর  আপনি ভাবুন আপনার জীবন কতোটা সত্য আপনার জীবন বদলে যেতে পারে এটি পড়ার পর।   
তাপস প্রধানের লেখা ( ভাব মুক্তি)  এই বইটি থেকে
নেওয়া ।।

প্রথম পর্ব

জন্মের সন্ধিক্ষণের শুভ সূচনাই হল জীবন কথাটির শুরু। মহামানব তীর্থের দুটি প্রাণের স্নেহ মমতার মিলন সুত্র ধরেই কুসুমিত হয় মানবরুপী এক শিশু পুষ্পের।
এবং এই ফুটন্ত পুষ্পই জীবন নামের হাত ধরে নিজেকে জীব বলে প্রমাণিত করে ধরণীতে। শুরুতেই জীবন যখন ধরণীতে দেহ স্পর্শ করে। তখন এই
প্রতিশ্রুতির হাত ধরে প্রতিঙ্কিত হয় যে সে সত্যের হাত ধরে চলবে, হিংসাকে স্পর্শ করবে না এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বড় হবার হুঙ্কারটাকে কখনােই
সে এগিয়ে নিয়ে যাবে না। ধর্মের প্রতি, কর্মের প্রতি এবং তার জন্মদাতা ও দাত্রির প্রতি। ও তাকে প্রেরিত সেই আরাধনার মহাশক্তির প্রতি সব সময় শত ব্যবহার, সৎ চেষ্টা ও সৎ ন্যায় বিশ্বাসের দ্বারা নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাবে জীবনের সেই মুহূর্তের কাছে। যে মুহূর্তকে সকলে হাসি, খুশি এবং চলন বলনের মধ্যে শান্তির আলিঙ্গন করতে চায়। কিন্তু জীবন যােদ্ধা শিশুরা জ্ঞান শক্তি বৃদ্ধির দ্বারা যতই জীবনের দিকে এগােতে থাকে ততই ভুলতে থাকে তাদের শুরুর প্রতিশ্রুতি গুলি। ভুলতে থাকে তারা তাদের কর্তব্য এবং দায়িত্ব ভারগুলি।
আর সব জীবনের মত তারাও তাদের জীবনটাকে ভাসিয়ে দেয় অনেক অগােছালাে সবকিছুর মধ্যে। তারা আত্মত্যাগের পরিবর্তে আত্ম গঠনের চিন্তাভাবনায় ডুবে থাকে অতীত ভবিষ্যতের সবকিছুকে ভুলে। বর্তমানের রূপরেখাগুলিকে ভুল পথের সন্ধান দেয়। এবং নিজের দেহ দেশের উজ্জ্বল সুখটার উদয়কাল পরিবর্তন করে অন্তের সীমানায় পৌঁছে দেয়। এই সব প্রক্রিয়া কখনোই জীবন কথাটির জন্মের পর থেকে মৃত্যু এই মহৎ সময়ে সব জাতির 'অন্তর্দেশে ঘুমিয়ে থাকে অর্থ হতে পারে না।
আমার মতে জীবন কথাটির অর্থ হল (জাবিত বন্ধুর ন্যায়) বন্ধুত্বের সেই মহাশক্তি। ঘুমিয়ে থাকে মানবতাবােধ। বন্দী হয়ে থাকে বহির্জগতের
প্রাপ্ত অনেক কিছু। এত সৌন্দর্যময় পৃথিবীর সর্ব সৌন্দর্যের সুত্রই হল মানবের ইচ্ছা শক্তি। আর সেই ইচ্ছা শক্তির দ্বারাই সামনের সব কিছুকে সুন্দর করে
তুলি আমরা। কিন্তু আসল সৌন্দর্যটাকে কখনােই গড়ে তুলতে চেষ্টা করি না। এই চেষ্টাহীন মনােবৃত্তির জন্যই আমরা পারি না আমাদের ভেতরের অনেক
সত্ত্বাকে জাগিয়ে তুলতে। যা পারে মানবের চরিতার্থ গঠন করতে। এবং মানব জীবনে সব সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু আমরা প্রকৃতির কোন কিছুর মত।
নয়। যে বৃক্ষ তার ফলগুলিকে প্রকৃতি, মাটি, সূর্য এবং কত ঝড় ঝাপটাকে প্রতিহত করে। দিনে রাতে এত লড়াই করে বাঁচানাে ফুল-ফলগুলিকে সে নিজের
হাতে না রেখে করে দেয় সর্ব সকলের কাছে।
এই প্রকৃতির বুকে যেমন জল, আলাে, বাতাস, প্রবল শক্তিশালী তারা চাইলে এই সুন্দর স্বপ্নময়ী পৃথিবীকে এক নিমেষে শেষ করে দিতে পারে আবার তাদেরই
স্থিরতা গড়ে তােলে এই প্রকৃতির বুকে কত সৌন্দর্যতা, অসংখ্য মায়া, মমতা , আশা, ভরসা, বিশ্বাস দান করে যায় কত অসংখ্য জীবনের মাঝে, ভেঙে যাওয়াকে
গড়ে তােলে আবার কত ঘুমন্ত জীবনকে জাগিয়ে দেয়। ঠিক এই রকম জীবনের তালিকায় চারটে জিনিস খুব শক্তিশালী। (১) সততা, (২) অহিংসা, (৩) ভালােবাসা,
(৪) চেষ্টা
(১) সততা—বর্তমান যুগের কাছে বড়ই মূল্যহীন, বিশ্বাসহীন এবং দুঃখ দারিদ্রতা মাখানো এক কঠিন অবক্ষয় ভেবে, তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি দূরের
এক মিথ্যার ডাস্টবিনের মধ্যে। আর আমরা মিথ্যার হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে চলেছি, মিথ্যাশ্রিত প্রজন্মকে। ফেলে দেওয়া সত্যের জায়গায় যদি মিথ্যাটাকে
ফেলে দিয়ে সত্যটাকে তুলে এনে যদি তার হাত ধরে জীবনে চলা যায় তাহলে জীবনের শুরুতে দারিদ্রতা অর্থের অভাব হয়তাে থাকবে কিন্তু মনে শান্তির
বিকাশের অভাব হয়তাে হবে না। মনের মধ্যে কোন ভয়ের অবকাশ ঘটবে না । ভালােবাসার মধ্যেও গড়ে উঠবে এক নতুনত্ব। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার এক
উজল প্রচেষ্টা, আর সেই প্রচেষ্টাই পৌঁছে দেবে জীবনের এক সুন্দর লক্ষ্যে। এবং সেই লক্ষ্যকে কোনদিন কেউ ছেদন করতে পারবে না। চারিদিকে এক নতুন সুখ শান্তির উজ্জ্বলত ঘুরে বেড়াবে। তখনই অনুভব করা যাবে। সত্য দুঃখ, যন্ত্রণা, নিয়ে প্রবেশ করলেও তার পশ্চাতে নিয়ে আসে সে অনেক বেশি সুখ শান্তির বিশাল রত্ন ভান্ডার যাকে কেউ ভেঙে ফেলতে পারে না। যার আনন্দ কোনদিন শেষ করা যায় না। যার মাধুৰ্য্যতাকে চলন্ত জীবনের আন্তরিক সম্পদ ভেবে আলিঙ্গন করা যায়।
 (২) অহিংসা—এই জগতে জীবনকে পিছনে টেনে রাখার সুত্রই হল হিংসা,
আর এই হিংসা আমাদের প্রত্যেকের কাছে রােজের আহার বাহারের মতন প্রবেশ করে আছে আমাদের মনের মধ্যে। এবং বিশ্বাসের মধ্যে, তাই তাে আলাের জগতে থেকেও আলােকে উপভােগ করতে পারি না। পারি না অহিংসার চোখ দিয়ে দেখে সঠিক বিচার করতে। তাইতো ভুল আর ভুল মাকড়সার
জালের মতন ঘিরে রেখেছে চারিদিক নিয়ে। আমরা হিংসাকে সঙ্গী করে এইটুকু ভুলে গেছি যে হিংসার দ্বারা কোন কিছুকে জয় করা যায় না। হিংসার দ্বারা
নিজেকেই শুধু বড় করা যায় কিন্তু বাইরের জগতের কাছে অনেক বেশি ছােট্ট করে দেয়। অহিংসাই জগতের মূলশক্তির উৎস, অহিংসার দ্বারা সবকিছুকে জয় করা যায়।
 বিশ্বাস পাওয়া যায়, ভরসা পাওয়া যায়, পাওয়া যায় খুশি আনন্দের এক বৃহৎ সত্যকে। চারিদিকে নতুনের বিকিরণ ঘটে। ফিরিয়ে আনা যায় হারানাে অনেক কিছুকে। এক অহিংসাই অনেক হিংসা বিকৃত মনকে ভালােবাসার বন্ধনে ফিরিয়ে আনতে পারে।।

(৩) ভালােবাসা জীবনের শুরু থেকে শেষ এই মহৎ সময়ের একমাত্র সঙ্গী হল ভালােবাসা।

 তাই ভালােবাসা শুধু শারীরিক সম্পর্কের মধ্যেই বেঁচে থাকে না। বেঁচে থাকে আন্তরিকতা আর বিশ্বাসের মধ্যে। জীবনের সমস্ত ভুল সমস্ত ঘৃণা এবং সমস্ত বিচ্ছেদের আসল সংশােধনের আস্থাই ফল ভালােবাসাভালােবাসাকে বিক্রি না করে তাকে আপন করে নেওয়াটাই আমাদের মূলধর্ম। ভালােবাসা হল একই বৃক্ষের ভিন্ন আকারের ফল। তাই দুঃখ যন্ত্রণাময় জীবনে সুখ শান্তিকে পাওয়ার জন্য কখনােই অপর বৃক্ষের ফল গ্রহণের প্রয়ােজন নেই।
আন্তরিকতার দ্বারা গ্রহণ করলে এক বৃক্ষের ফলের মধ্যেই। ভিন্ন বৃক্ষের মলের স্বাদ পাওয়া যায়। কর্মজীবনে প্রত্যেক মালিক পক্ষের কাছে যদি ভালোবাসা সঙ্গী হয়ে থাকে
তাহলে তার দ্বারা কর্মের উপযুক্ত কর্মচারীকে উৎসাহী করে তােলা যায় এবং তার দ্বারা মালিকদের এগিয়ে নিয়ে যায় উন্নতির উজ্জ্বল আলাের রেখার দিকে।
ভালােবাসা প্রত্যেকের মনে উদিত সূর্যের ন্যায় প্রখর। সেই প্রখরতাই যেন জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায় আরাে বেশি আলোর জগতে
(৪) চেষ্টা—চেষ্টাও হল জীবনের আর একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
চেষ্টা করলে হবে না এমন কোন কাজ নেই এই মানব জগতে। মনের মধ্যে বিশ্বাস রেখে চেষ্টার হাত ধরে এগিয়ে গেলে জয় কেউ রুখতে পারবে না।
পার্থক্য শুধু সময়ের ব্যবধানের। কর্মের মূল উৎসই হল চেষ্টা আর চেষ্টার উৎসই হল এগিয়ে যাওয়া। একটি শিশু চেষ্টার দ্বারাই ধীরে ধীরে বড় হয়ে
ওঠে। একটি সুপ্ত বীজ চেষ্টার দ্বারাই প্রকৃতির কাছ থেকে তার প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করে ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে প্রকৃতির বুকে। তাই আমাদের
প্রত্যেকের মধ্যেই চেষ্টা ঘুমিয়ে আছে। তাকে জাগিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই হল আমাদের জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানাে। এমনকি সে নিজের প্রজন্ম গঠনের জন্য সে তার স্নেহ মমতার একবিন্দুকেও ধরে রাখতে পারে না। সময় অনুসারে পুণরায় সে লড়াই করে সৃষ্টি করে দানও
করে দেয় সবকিছু। স্রোতধারী নদীও চলতে চলতে খুজে বেড়ায় অন্য কোন পথ, যে পথে সে তার নিজের দেহকে বিস্তার করে ভরিয়ে দিতে চায়। কতেক
জীবনের শূন্য উচ্ছাসগুলিকে। নিজে আঘাত প্রাপ্ত অবস্থায় চলেও সকলকে দান করে বেঁচে থাকার স্বপ্নগুলি। এইভাবে প্রকৃতি আমাদেরকে অনেক কিছুই দান। করতে থাকে। কিন্তু আমরা তাদের দানকে শুধু স্বেচ্ছায় গ্রহণ করিনা বরং তাদের কাছ থেকে আরাে কিছু পাওয়াকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে আমাদের
বেশি পাওয়াটাকে দেউলিয়া করে তুলি। এইটাই আমাদের কাছে ভগ্ন বিশ্বাস। তাই তাে আমরা নিঃশ্বাসটাকে প্রকৃত সময়ের কাছে পৌঁছে দিতে পারি না। কত আশা কত স্বপ্নকে সঙ্গে নিয়ে ছুটতে ছুটতে অজ্ঞাতভাবে পড়ে যাই মৃত্যু গহূরে।
আর স্বপ্ন আশাগুলি শুনেই ভেসে থেকে যায় কারাের অপেক্ষায়। জীবনে ধর্ম যাত্রার আসরে আমরা সকলেই অভিনয় করে চলি। সে চেয়ে খাওয়া ভিক্ষুক
থেকে নিয়ে কোটিপতি পর্যন্ত। সকলেই সর্ব দেবতার সামনে করজোড়ে নিজের দুঃখ, যন্ত্রণা, চাওয়া, পাওয়ার গােপন উক্তিকে প্রকাশ করি। আপন ইচ্ছাপূরণের জন্য। কিন্তু বিবেকহীন, বুদ্ধিহীন, জ্ঞানহীন স্বার্থলােভী মানুষ আমরা। তাই যথাসময়ে
ইচ্ছাটা পূরণ না হলেই ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস মন থেকে মুছে ফেলি। মনে মনে তাকে কতরকম ভৎসনা দিতে থাকি। তাকে লক্ষ্য করে দেওয়া নকুলদানা,
বাতাসাগুলি বন্ধ করে দিয়ে সামান্য টাকা বাঁচিয়ে বিশ্বাসের দেবতারে, অবিশ্বাসের জায়গায় ছুড়ে ফেলি। কিন্তু সময়ের হিসাব নিকাশ তখনই শেষ হয়ে যায় না।
জীবনের মুহূর্ত কখন যে বদলে যেতে পারে, তা কেউই বলতে পারে না। তাই আরাধনার দেবতার সামনে গিয়ে বিপদটাকে রুখে দেওয়ার প্রার্থনা করি। আর
আবার কোন মুহূর্তে যখন বিপন এসে দাঁড়ায়। তখনই আমরা আবার আত্ম যদি সত্যিই সেই বিপদ রুখে যায় তাহলে ভগবানকে সত্যিই ভগবান ভাবি, না
হলে ভাবি শয়তান। আমরা এইটুকু ভাবিনা যে যেটা হবার সেটা যে কোনভাবেই হবে। কেউ তাকে রােধ করতে পারবে না। কিন্তু আমাদের বােধশক্তি বিশ্বাস
অবিশ্বাসের। তাই না পাওয়ার বিশ্বাসটাকে অবিশ্বাসের হাতে তুলে দিই। সত্যিই যদি আমাদের দেওয়া দান দেবদেবীরা গ্রহণ করতেন তাহলে তাদেরকে দেওয়া আহার সামগ্রী আমরা দু'চারদিনের বেশি কখনােই দিতাম না। তাদেরকে আমরা এইটুকুই দিতাম যে হয়তাে তাদেরকে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে ফেলতাম, না হয় তাদের দানের ভয়ে কোন ছলনায় তাদের তুলে আছাড় দিতাম। শুধু তাহারা কোন কিছু গ্রহণ করে না বলেই আমরা তাদেরকে শ্রদ্ধা করি, ভক্তি করি, মনের দুঃখ কষ্ট মুখ চোখ, হাত, পা বেঁধে অন্ধের মতন একস্থানে বসিয়ে রাখতাম। আর না হয় বিপদ আপদকে কর জোড়ে জানাই সবকিছুর মুক্তি সাধনের জন্য। কিন্তু ভুল আমাদের একটাই যে, সত্য লাভের জন্য সময়কে অপেক্ষা করি না। জীবনে আশায় বৃক্ষ স্থাপন করি এবং তার কাছ থেকে ফল চেয়ে বসি। কোন মতেই
কোন কিছুকেই চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যায় না। যেমন আমরা ফলের সে বৃক্ষ আমাদের আশা পূরণ করতে পারে না।
 তবু আমরা আমাদের চাওয়াটাকে অপেক্ষায় রাখতে না পেরে কৃত্রিম উপায় বৃক্ষটির উপর প্রয়ােগ করে তার পরিপূর্ণ দানের শক্তিটাকে আমরা জোর করে ছিনিয়েনি। ফলে ঐ ছিনিয়ে নেওয়া
ফলটি আমাদের শরীরের পক্ষে উপযােগী হয়ে ওঠে না। এবং সময়ের অধিক পাওয়াটাও মেটে না। প্রাপ্য জীবনে এটাই সত্য যে চাওয়ার মুহুর্ত কখনােই
পাওয়ার যােগ্য হয়ে ওঠে না। সময়ের অপেক্ষাতেই পাওয়ার যােগ্য মূল্য লাভ করা যায়। ঈশ্বর কখনােই আহারের অপেক্ষায় বসে থাকেন না। তিনি সেই
অপেক্ষাতেই বসে থাকেন যে মানুষ বিশ্বাসের দ্বারা, ভক্তির দ্বারা এবং অপেক্ষার দ্বারা তাকে স্মরণ করলেই তিনি শরণাপন্ন হন। এবং দিনরাত উপবাস করে,
নিজের আত্মাকে কষ্ট দিয়ে কখনােই ঈশ্বরাসীষ লাভ করা যায় না। ক্ষুধার যন্ত্রণা পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রণা থেকে বড় এবং ঈশ্বর কখনােই বলেননি নিজেকে কষ্ট
দিয়ে আমার মন ভরাও। এবং বলেননি তােমরা ঢাক ঢোল বাজিয়ে, জাগিয়ে তেল আমাদের। নিজের মাথা ঠুকে রক্ত বার করে। আমার চক্ষু দৃষ্টিকে তােমাদের
উপর ফেলিয়ে। তােমাদের সব চাওয়া পাওয়াকে পূর্ণ কর। নিজেদের বিশ্বাস নিজেদের কাছেই বড়। কিন্তু এই বিশ্বাসটা আমরা দান করি এই কারণে যে
আমাদের চাওয়াটাকে পাওয়ার জন্য। আসলে বর্তমান আমরা এত বেশি চেয়ে ফেলি যে যা আমাদের প্রাপ্যের যােগ্য চাওয়া নয়। আর যখন আমাদের অতিরিক্ত
পাওনাটা পুরণ না হয় তখনই আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের আরাধনার দেবদেবীকে ভৎসনা দিতে থাকি। তার প্রতি ঘৃণার সৃষ্টি করি। বিশ্বাস হারাই, আর নিজেদের কপাল চাপড়ে বলতে থাকি বেকার বেকার তাকে এতদিন ফুল ফল দিয়ে এসেছি কত টাকার কাপড় দান করে এসেছি। সবটাই বেকার হয়ে গেল। কিন্তু আমরা কখনােই আমাদের লোভের ভুলটাকে মানতে চাই না। ভাঙতে চাই না। আত্ম অহঙ্কারের কাঠামােগুলােকে। তাই তাে সম্মুখে আর্থিক উন্নতি আসতে থাকলেও, পশ্চাতে অহঙ্কারের ক্ষয় হতে থাকে। বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে আর্থিক উন্নতি থেমে গেলেও অহঙ্কারের ক্ষয় কিছুতেই থামে না। সে ঝরতে
থাকা চুলের মতনই মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত বারতে থাকে। তাই তাে আমরা গাছের মধ্যে থাকা যুটাকে সময় মত যত্ন নিয়ে তাকে গাছের সৌন্দর্যে ধরে রাখতে চাই না। যখন সে মাটিতে ঝরে পড়ে তখনই তাকে আমরা লক্ষ্য করে ভাবতে থাকি তার ঝরে পড়ার কারণটা। কিন্তু যখন আমরা সেই কারণটা। অনেক কষ্টে জেনে ফেলি তখন তাকে তুলে তার জীবিত স্থানে পৌছে দেওয়া
কারাের পক্ষেই সম্ভব হয় না। কারণ মৃত্যুর হাতে যে স্পন্দন আবদ্ধ হয়ে যায়। সে স্পন্দন কখনােই পশ্চাতের দিকে এগােয় না। তাই তার আশা স্বপ্নের কোন পূর্ণ প্রাপ্তিও ঘটে না। এক খুব নামী ডাক্তার যে চিকিৎসায় ভগবানের সমান ,সেও কোন বড় অপারেশনের আগে লেনদেনের হিসাবটা যতই ভালাে করে করুক না কেন অপারেশন শুরুর আগে অবশ্যই সে তার আরাধনার ঈশ্বর কে স্মরণ করে তবেই ছুরি কাচি ধরেন। আর বাইরে অপেক্ষা করা রােগীর বাড়ির
লােকের প্রতি নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে রক্ষা কর প্রভু, রক্ষা কর প্রভূ বলে কামনা করে বসে থাকেন ভেতরে থাকা রােগীর জন্য। কারণ বিশ্বাসে ঈশ্বর ঘুরে বেড়ালেও
নিঃশ্বাসে মৃত্যু খেলা করে। তাই কার অন্যমনস্ক কে জয়ী হয়ে যায় বলা দুস্কর। আবার কোন ইঞ্জিনিয়ার শিক্ষা এবং অতিরিক্ত কর্মের উপার্জিত আর্থিক অহঙ্কারে পরিপূর্ণ হয়ে কোন দেবদেবীর পূজা পার্বনে খােলা হাত উঁচু করে জোর করেন না। কারণ তিনি সব দিক দিয়ে সর্বেসর্বা মনে করেন। কিন্তু তারা যখন মা বা
বাবা হতে যান তখন তাদের সেই নাস্তিকতা ভালােবাসার পরশ মেখে ভবিষ্যতের সুন্দর বংশধর প্রাপ্তির তৃষ্ণানায় কাতর হয়ে আস্তিকতায় পরিণত হয়ে যায়। এবং অহঙ্কারের সেই ঝােলা হাত দুটি নির্দ্বিধায় বিশ্বাসী ভগবানের প্রতি একসঙ্গে উঠে বলতে থাকে রক্ষা কর ভগবান রক্ষা কর। প্রত্যেকের জীবনের আশেপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে, এক অদৃশ্য শক্তি, যার জড়তাকেই আমরা মুর্তির আকারে এদিক
ওদিক দেখতে পাই। আসলে সেটা একটা শুভ শক্তি, যার অনুভূতি বিশ্বাসের দ্বারাই লাভ করা যায়। কর্মশক্তি এবং শুভ শক্তির দ্বারা এই মহাবিশ্বে কত
কিছুই না ঘটে যায়, যাকে আমার কেউ ভাবি না, বুঝি না এবং অনুভব করার চেষ্টা করি না। তাই আমরা শিক্ষার দিক দিয়ে অসাধারণ হলেও, সত্য শান্তি,
কর্মীক ধার্মিকের পথে ইচ্ছামত পা ফেলতে না পারায় নিজেদের ভারসাম্যটাকে হারিয়ে ফেলি। অতএব এটাই আমাদের সঠিকভাবে জানা উচিত যে, আমাদের
প্রত্যেকের ইচ্ছা শক্তির মধ্যেই লুকিয়ে আছেন আমাদের আরাধনার ঈশ্বর। শুধু কর্তব্য এবং শত বিশ্বাসের দ্বারাই তিনি জাগেন। আবার হিংসা অহঙ্কারেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। যেমন
(১) পাশাপাশি দুটি গাছ যাদের দূরত্ব প্রায় হাতখানেক। গাছের গােড়ায় গাছ থেকে নিঃসৃত কোন পিচ্ছিল পদার্থ আঠার আকারে পড়ে আছে। একটি মাকড়সা, একটি গাছে বসে তার খাদ্য শিকারের জাল বােনার জন্য আর একটি গাছে যাওয়ার উপায় কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না। সে ঐ গাছটাতেই কিছুটা দূরত্বে ঝুলে আছে এই আশায় যে, আর একটি গাছ স্পর্শ করতে পারলেই জাল বুনে
কিছুতে জীবনে ফিরে আসবে না। আবার যে যদি ওপরের ডালপালার দিকে আহারের ব্যবস্থা করতে পারবে। কিন্তু সে কিছুতেই তার ইচ্ছাটাকে পূরণ করতে
পারছে না। কারণ নিচে তার মৃত্যু হাত বাড়িয়েই আছে। সেখানে সে পড়লে। যায় তাহলে সেখানে কোন পাখিরা তাকে মেরে ফেলবে। একমাত্র কোন হাওয়াই
পারে তাকে এক গাছ থেকে অন্য গাছে পৌছে দিতে। এই সব ভাবনায় সে বড়ই চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ইচ্ছা শক্তি ভগবানের এমনই মহিমা এক
ঝাঁক পাখির দল ঐ গাছের পাশ দিয়ে উড়ে চলে গেল। আর তাদের উড়ে যাওয়ায় যে হাওয়ার উৎপত্তি হল সেই হাওয়াতেই মাকড়সাটা কখন যে অন্য
গাছে পৌঁছে গেছে সে বুঝতেই পারেনি। সে ভেবেছে হয়তাে সেই গাছটাকেই। সে ধরে আছে। কিন্তু না, সে ঘুরে দেখে তার জালবােনার আটালাে সুতাে দুটো
গাছকেই স্পর্শ করে আছে। মাকড়সাটি মনের আনন্দে জাল বুনে আহার এবং থাকার ব্যবস্থা করল।
(2) এক ছােট্ট গরীব পরিবার, কর্তা গিন্নি আর সাত বছরের ছেলে, তিন বছরের মেয়ে এবং এক বৃদ্ধা মা, সকলের আহার-বাহার, সুখ, দুঃখ, হাসিখুশির।
একমাত্র উপার্জনের মাথাই হলেন কর্তা এবং সে কর্তার কমই হল ঘুগনি বিক্রি করা। ঘুগনিটা ঘরে গিন্নি বেশ মন দিয়ে বানিয়ে দিতেন। কারণ তার সেই
বানানাের উপরেই নির্ভর করছে বিক্রি এবং বিক্রির উপর ভরসা করে আছে পাঁচটি প্রাণের আহার-বাহারের আশা। কর্তা, গিন্নি, বৃদ্ধা মা সকলেই ঈশ্বর
বিশ্বাসী নিজেদের দারিদ্রতার জন্য। তাই প্রতিদিন কর্তা বেরােনাের সময় সকলেই ঈশ্বরের নাম নিয়ে তবেই ব্যবসার দিকে এগােতে থাকেন। শীত, গ্রীষ্ম, বর্যা প্রায়
দিনই তার ঘুগনি বিক্রি হয়ে যায়। একবার প্রতি বছরের মত সে বছরেও তাদের গ্রামীণ পুজো হবে গ্রামের সকলেই যে যার সামর্থ অনুযায়ী নতুন জামাকাপড়
পরে। কর্তা তার নিজের হােক না হােক তবু মা, বৌ এবং বাচ্চাদের যেমন পারে তেমনই লিনে দেয়। একবার পুজোর মাসখানেক আগে তার বিক্রির
বাজারটা খুব মন্দা দেখা দিল। ঐদিকে ছেলেমেয়ে ভালাে জামাকাপড় চেয়ে বসেছে। গিন্নির ইচ্ছা ভালাে শাড়ি কেনার আর তার মা এবং নিজের তেমন
কোন বাছাই নেই। কর্তা বড় চিন্তায় ঘুগনি বিক্রি করতে লাগলেন। যতই পুজোর দিন কাছে এগিয়ে আসতে থাকে ততই তিনি চিন্তিত হয়ে যান আর্থিক
টানের চিন্তায়। পুজোর জন্য মাত্র পাঁচদিন বাকি আছে। কিন্তু কিছুই কর্তা কারাের জন্য কিনতে পারেননি। একদিন রাত্রে ফিরে এসে অনেক চিন্তা ভাবনায়
স্থির করলেন যে কাল থেকে বেশি করে ঘুগনি বানিয়ে রাত পর্যন্ত বিক্রিনকরবেন। ঠিক তাই করলেন আগের চেয়ে বেশি ঘুগনি বানিয়ে বেরিয়ে পড়লেন
বিক্রি করার জন্য। অনেক আশা নিয়ে কর্তা সকাল থেকে হাঁকতে হাঁকতে সন্ধেয় পৌছালেও তার ঘুগনির এক চতুর্থাংশ বিক্রি হল না। মনের দুঃখে
ঠেলাটাকে এক জায়গায় রেখে মাথায় হাত দিয়ে চোখের জল মুছে বললেন, হে ভগবান কেন আমায় এমন শাস্তি দিচ্ছ, আমাকে না হয় কিছু না দাও কিন্তু
আমার ছেলেমেয়েদের মুখে একটু হাসি ফোটাও ওরা তাে কোন অপরাধ করেনি,আর আমি তােমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না প্রভু। এই বলে মনের দুঃখে
ঘুগনি ঘুগনি বলে বাড়ির দিকে ফিরে যাচ্ছেন। ঐ রাস্তার পাশেই গৃহস্থের বাড়িতে বাচ্চার জন্মদিন পালন হচ্ছিল। তাতে অনেক বাচ্চা এবং অতিথি
নিমন্ত্রিত হয়েছেন। রাতে লুচি আহার সেরেই সব ফিরছেন বাড়ি। ঘুগনিওয়ালা ঐখানেই দাঁড়িয়ে পড়েছেন এই আশায় যে তার ঘুগনি যদি কিছুটা বিক্রি হয়। গৃহস্থের বাচ্চারা যখন খেতে বসেছে হঠাৎ একটা বাচ্চার খাবারের থালায় ছােলার ডালের মধ্যে এক টুকরাে টিকটিকির লেজ দেখে বাচ্চাটা চিৎকার করে
ওঠায় পুরাে অনুষ্ঠান বাড়িতে হৈ চৈ পড়ে যায়। তখন আর সময় ছিল না যে নতুন করে বানিয়ে সবাইকে খাওয়ানাের। কিন্তু বাইরের বানানাে ঘুগনির আওয়াজটা ঐ ঘরের খােলা জানালা দিয়ে ঢুকে কয়েকজনের কানে পৌঁছেছিল। কিন্তু বড়রা
সে শব্দকে মনে মাখেনি। কিন্তু বাচ্চাদের কানে প্রবেশ করতেই তারা বলে উঠল ঐ তাে ঘুগনি বিক্রি হচ্ছে। এই কথায় গৃহ কর্তা কোন উপায় না পেয়ে ইচ্ছা ।না থাকা সত্যেও ঐ ঘুগনিওয়ালাকে ডেকে তার সমস্ত ঘুগনি তার আসল বিক্রির মূল্যের চেয়ে আরাে দু’গুণ বেশি মূল্য দিয়ে কিনে নিলেন এবং তার খাবারের সুস্বাদুতার বাহবা দিয়ে তাকে আরাে কিছু লুচি এবং মিষ্টি দান করলেন এবং বললেন তুমি রােজ এক কিলাে করে ঘুগনি আমাদেরকে দিয়ে যাবে। এছাড়া আরাে ওখানে থাকা অনেকেই হয়ে গেলেন প্রায় রােজের খরিদ্দার।
গরীব ঘুগনীওয়ালা প্রসন্ন মনে ভগবানকে প্রণাম করে বাড়ি ফিরলেন। এবং সব কথা তার গিন্নি, মাকে বলার পর বললেন জানতাে ভগবান প্রত্যেকের ইচ্ছা।
শক্তি এবং বিশ্বাসের মধ্যে আছেন এটা সত্য। এবং বিশ্বাসের ঐ সত্যের দ্বারাই তার ছেলে, মেয়ে, গিন্নি, মা এবং নিজের সমস্ত বাহারের ইচ্ছাগুলি পূরণ হল।
(৩) এক অন্ধ ভিক্ষুক তার এক ছােট্ট ছেলের হাত ধরে সকালবেলায় বেরিয়ে পড়ে ভিক্ষার পাত্র নিয়ে। বাড়িতে অসুস্থ গিন্নি এবং জ্ঞানহীন শক্তিহীন তার জীবন। বাড়িতে থাকে এক ছােট্ট মেয়ে এবং বৃদ্ধ বাবা। এতগুলাে ভাঙা চোরা জীবনের ভরসা হল অন্ধ ও তার হাত ধরা ছোট্ট ছেলেটি। কোনদিন একশােটি টাকা উপার্জিত হয় আবার কোনদিন তার থেকে কিছু বেশি, আবার কোনদিন কম। এইভাবে ওঠানামা উপার্জনের মধ্যেই নুন ভাত, ডাল ভাত, কিংবা আলু ভাত খেয়েই কাটে তাদের পাঁচটি জীবনের দিনরাত। তার মধ্যে
অসুখের ওষধু আনতে কিছুটা ধার দেনাও হয়ে যায়। এই বহু চিন্তার মধ্য দিয়েই কাটে তাদের দিন। সারাদিন ঘুরেও উপার্জনটা কিছুতেই তাদের বাড়ে না।
কয়েক দিনের মধ্যেই অন্ধের বাবা মারা যান। বাবার শ্রাদ্ধ শান্তির জন্য টাকারও প্রয়োজন। কিন্তু বাড়তি টাকা তাকে দেবেই বা কে? 'আর দিলেই সে কি
করে শােধ করবে। কোন কোনদিন নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যায়। বড় চিন্তায় পড়ে যায়। অন্ধ। তবু যেমন করেই হােক বাবার শ্রাদ্ধ শাস্তি তাে করতেই হবে।
কয়েকজনের কাছে সামান্য সামান্ত টাকা ধার চেয়েও পাওয়ার কোন আশাই পেল না। হাতে মাত্র দশটা দিন বাকি। বিশ্বাস একমাত্র ভগবান। আর ভিক্ষার
পাত্র, বেরিয়ে পড়ল রােজের মতন ভিক্ষার রাস্তায় কিন্তু দুর্ভাগ্য যে উপানের কোন উন্নতিই হল না। এইভাবে দিনের পর দিন কেটে যায়, কিন্তু বাবার শ্রাদ্ধ
শান্তির জন্য কোন বাড়তি টাকা আর জমাতে পারে না। শ্রাদ্ধের দিন যতই এগিয়ে আসে তার চিন্তার বােঝাটা ততই বাড়তে থাকে। এইভাবে আটটা দিন
তার পেরিয়ে যায়। তার কাছে জমেছে মাত্র পঞ্চাশটি টাকা যা দিয়ে শুধু একটি গামছাই কেনা যায়। নয় দিনের মাথায় অন্ধ ও তার ছােট্ট ছেলেটি ঘরের
দেবদেবীর মূর্তির কাছে গিয়ে দুজনেই হাতজোড় করে তাদের দুঃখের কথা জানিয়ে ভিক্ষা করতে বেরিয়ে পড়ে। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত রােজের
উপার্জনের চেয়ে মাত্র অর্ধেকটা ভিক্ষা প্রাপ্ত হল তাদের। অন্ধ হতাশায় ভগবানকে বলতে লাগল তােমাদের এত বিশ্বাস করে বলে এলাম তবুও আমাদের বিশ্বাসটা রাখলে না। তােমাদের যেদিন আমরা প্রণাম না করে আসি সেদিন আরাে বেশি ভিক্ষা পাই। এই দুঃখে অন্ধ একহাতে ভিক্ষা পাত্র এবং একহাতে ছেলের হাত
ধরে বাড়ির দিকে এগােচ্ছে। বাটিতে মাত্র কয়েকটি খুচরাে পয়সা পড়ে আছে। এক দল বিদেশী তাদের বিপরীত দিক দিয়ে আসছিল। অন্ধের হাতে ভিক্ষা পাত্র
দেখে তাদের মধ্যে একজন একশােটি টাকা ঐ পাত্রে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আর সকলে পঞ্চাশ টাকার নােট ঐ পাত্রে ফেল্লার ভিক্ষুকের শূন্য পাত্রটি পূর্ণ
হয়ে গেল। অন্ধ এবং তার ছেলের মন খুশিতে ভরে উঠল। তার মাথায় যে একটা চিন্তার বােঝা চেপে বসেছিল তা আপনা থেকেই পায়ের তলায় পড়ে
কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। অন্ধ বাড়িতে ঢুকেই সােজা ঠাকুরের সামনে সটান হয়ে শুয়ে হাতজোর করে বলল তােমরা আমায় ক্ষমা কর ভগবান। আমি
না জেনে বুঝে তােমাদেরকে কত কিছুই না বলেছি। আজ বুঝলাম আমাদের ইচ্ছা শক্তির আশেপাশেই তােমরা ঘুরে বেড়াও। শুধু আমাদের সত্য বিশ্বাসের
অপেক্ষায়। আমরা যদি অন্তর দিয়ে তােমাদের কাছে প্রার্থনা করি তাহলে তােমরা শান্তি সম্পন্ন করল।
ঠিক সময়ে ঠিক সমস্যার সমাধান করে দাও। অন্ধ নির্ভাবনায় তার বাবার শ্রাদ্ধ
(৪) রাস্তার ধারে একটি আমগাছ। আমের সময়ে প্রচুর আম ফলে তাতে। যে যেমনভাবে পায়ে গাছটির ওপর অত্যাচার করে আম পেড়ে নিয়ে যেত। এক অন্ধ ভিক্ষুক বরাবরই সেখানে বসে ভিক্ষা চাইত এবং রাতে সেখানেই রাত কাটাতাে। কিন্তু আমের সময় আম পড়ার ভয়ে সে পাশের একটি গাছের গােড়ায় থাকত। আবার গাছে আমি ফুরিয়ে গেলে ঐ গাছের গােড়ায় চলে
আসত। গাছটিতে যেমন তার ফলন ছিল অধিক তেমন তার ফলের স্বাদও ছিল অধিক। অন্য বছরের মতন সে বছরেও গাছটিতে অনেক বেশি আম ফলেছে।
কাচা থেকেই সবাই আম ঝরানাে শুরু করে দেয়। পাকার সময়ও বেশ অর্ধেকটা থেকে যায় গাছে। কিন্তু প্রতি বছর পাকা আমের বেশির ভাগটাই খান অন্ধ
ভিক্ষুক। ভােরবেলায় উঠেই আগে তিনি পাকা আমগুলি কুড়িয়ে নেন। কিন্তু সে বছর কয়েকটি বেয়াড়া ছেলে ভােরের আগেই রােজ আম কুড়িয়ে নিয়ে যায়।
অন্ধ ভােরবেলায় গাছের গােড়ায় গিয়ে হাতড়ে হাতড়ে একটি আমও খুঁজে পান না। তার মনটা বড় দুঃখী হয়ে যায়। কারণ প্রতি বছর তিনি সুমিষ্ট আম দিয়ে
ভাত, রুটি খান আর এ বছর তিনি একটাও আম পাননি। দেখতে দেখতে আম প্রায় শেষ হয়ে আসল গাছে। তিনি ভাবছেন এ বছর কি পাপ তিনি করেছেন
যে একটাও আম আর কপালে জুটল না। তবু তার আশা মরেনি গাছে আম যখন আছে সে একটা না একটা পাবেই। এইভাবে গাছের আম দিনের পর দিন
শেষ হতে থাকে। দিনের বেলায় অন্ধ এর তার মুখে শুনতে পায় গাছে আর মাত্র দু'চারটে আম আছে। মনের আশায় অসহায় অন্ধ আগের মতন ঐ গাছের
গােড়ায় এসে থাকতে শুরু করে। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য যে শেষের আমগুলি এক একটা দিনের বেলাতেই পড়ে যেতে থাকে। যে পারে তাকে কুড়িয়ে নেয়। অন্ধ
বলে আমায় একটা আম পেলে দিও এ বছর আমি একটাও আম খাইনি। অন্ধের কথা কে শােনে বা মানে। কারণ সবাই জানে যে বেটা যখন গাছের গােড়ায় বসে থাকে তখন ঐ সব থেকে বেশি আম খায়। কিন্তু আবার ভুলও তাে হতে পারে যে সে চোখে না দেখার জন্য একটি আমও কুড়িয়ে খেতে পারেনি। আমরা সব সময় নিজের পাওনাটাকে এবং বিশ্বাসকে বড় বলে মনে
করি। নিজের প্রাপ্যের কোন কিছুতেই অন্যকে দিতে চাই না। এটাই আমাদের আসল ধর্ম, তবু অন্ধ দীর্ঘ নিঃশ্বাসে বলল হে ভগবান একটা আমও কপালে
জোটালে না। এরপর চার-পাঁচদিন কেটে যায়, অন্ধও ভুলে গেছে আমের কথা, আর গাছও তার সম্মুখের সব আম ঝরিয়ে ফেলেছে। এক রাতে অন্ধ ঘােমাচ্ছে
ঘুমে বেশ ভরপুর। হঠাৎ তার দুপায়ের ফাকে প্রকান্ড শব্দে যেন একটা পাথর খন্ড পড়ল। অন্ধের আচমকা ঘুম ভাঙল সে পায়ের ফাকে হাত দিয়ে দেখল
একটি বড়সড় জিনিস মনে হচ্ছে। যখন তাকে তুলে নাকের কাছে আনল। তখন সে বুঝল খুব বড় পাকা আম পেয়েছে সে। যা এ গাছের চারটে আমের সমান।
অন্ধ বলল হে ভগবান তােমার মহিমা অসীম, তুমি প্রত্যেকের ইচ্ছা শক্তির মধ্যে আছে এটা আমি মানি। আমটি আসলে স্বর্গ থেকে পড়েনি। দূর থেকে
গাছে যতই দেখা যাক যে গাছে আম নেই কিন্তু গাছের কোথাও না কোথাও এক দুটি আম থেকেই যায়। কারাের না কারাের ভাগ্যের জন্য। ঈশ্বরের বিচার
এমনই শ্রেষ্ঠ যে দশের একটি হলেও কারাের আশা অপূর্ণ থাকে না বরং পূর্ণ হয়। এবং তিনি একটি আশাকেই এমনভাবে পূর্ণ করেন। যা আশা করা মানুষের মন তাতেই ভরে যায়। আর তখনই নগণ্যের ঈশ্বর আত্মবিশ্বাসের কাছে শ্রেষ্ঠ হিসাবে গণ্য হয়ে যান।
(৫) একটি বড় পুকুর, পুকুরের এক প্রান্তে আছে একটি রাস্তা। সকলেই ঐ রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করে, একদিন বিকালবেলায় এক বয়স্ক ভদ্রলােক বাড়ি
ফিরছিলেন। তাকে ঐ পুকুরের পাশ দিয়েই রােজ বাড়ি ফিরতে হয়। সেদিনও ফিরছিলেন পুকুর শুরুর কিছুটা আগে তার জুতােটি হঠাৎ ছিড়ে যায়। তিনি মান
বাঁচাতে অন্য পায়ের জুতােটাও অন্য পায়ের জুতােটাও হাতে নিয়ে হাঁটতে থাকেন। পুকুরের মাঝ বরাবর আসার পর একটি ইটের টুকরাের উপর পা
পড়ায় ভারসাম্য হারিয়ে কিছুটা সামনে ছিটকে গেলেন। তার মুখ থেকে কটুক্তিও বার হয়ে গেল। তিনি আবার পিছনে ফিরে এসে ইটের টুকরােটিকে তুলে তার
সাধ্য অনুযায়ী পুকুরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন যা ডুবে মরগে। এই বলে তিনি আঘাতের প্রতিশোধের আনন্দে বাড়ির দিকে চলে গেলেন। জীবনইনি।
ইটের টুকরােটি পুকুরের জলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইটের সঙ্গে জলের স্পর্শের শব্দে একটি পানকৌড়ি জলে চুপটি মেরে বসেছিল মাছ খাওয়ার জন্য। সে
সঙ্গে সঙ্গে উড়ে যাওয়ায় পুকুরের একটি মাছের জীবন বাঁচাল। যদিও পানকৌড়িটির খাওয়ার কোন প্রয়ােজন ছিল না। কারণ সে দুপুরবেলায় কোন জল শুকিয়ে
আসা খাল থেকে পেট ভরে আনেক মাছই খেয়ে নিয়েছে। যা তার আর পরের দিন সকাল প্রচণ্ড না খেলে চলে যাবে। কিন্তু সে পুকুরের ভাসতে থাকা
মাছগুলি দেখে লােভ সামলাতে পারেনি। তাই আশায় জলের মধ্যে চুপটি করে বসেছিল। যদি একটা দুটো পেয়ে যায় তাহলে তার ভরা পেটে জায়গা না
থাকলেও আশার মনটা তাে ভরে যেত। বাস্তব জগতে শুধু পানকৌড়ি বা বলি কেন। আমরা তাে এসব লােভের ব্যাপারে কম নই। আমরা যতই ভরপেট
খেয়ে ফেলি। ফলে লােভের ঠেলায় অম্বল বা হজম। এমনকি পেট খারাপও খেয়ে থাকি না কেন, নতুন কোন জিনিস ক্ষতিকারক হলেও আমরা তাকে
হয়ে যেতে পারে। আমরা সেটা আগে থেকে ভেবে দেখি না এটাই আমাদের ভুল। প্ৰাপের জিনিসটাকে আমরা হিসাব-নিকাশের দ্বারা গ্রহণ করতে পারি না
বলেই ক্ষতির শিকার হয়ে যাই। এবং ঐ ইটটি জলের মধ্যে পড়ায় ঢেউয়ের উৎপত্তি হল এবং সেই ঢেউ যখন কিনারার দিকে এগােতে থাকল। তাদেরই
ধাক্কায় কয়েকটি কালাে পিপড়ে কিনারা ধরে বাঁচল। হয়তাে তারা আর কিছুক্ষণ জলের মধ্যে পড়ে থাকলে, তারা নিজের থেকেই মারা যেত না হলে কোন
মাছেরা তাদের মেরে ফেলত। যদিও পিপড়েগুলাে আকাশ থেকে খসে পড়েনি। পড়েছিল ওপরের গাছ থেকে। যেমন মাছের জীবন ভগবান পানকৌড়ির হাত
থেকে বাঁচালাে তেমনি পিঁপড়েগুলিও বাঁচলাে মানুষের মধ্যে উৎপত্তি হওয়া ইচ্ছাশক্তির ভগবানের দ্বারা। আবার ইটটি গিয়ে পুকুরের এমন একটি জায়গায়
পড়ল যেখানে জলের নিচে মাটিতে একটি গর্ত ছিল। সেই গর্তটার আশেপাশে মাছেরা আসতে ভয় পেত। কিন্তু ঠিক একই ইচ্ছাশক্তি ভগবানের দ্বারা মাটির
শূন্যতাও পুরণ হল এবং মাছগুলির মনের ভয়ও কাটল। একই সুত্রের হাত ধরে কত সমস্যার সমাধান করলেন ইচ্ছাশক্তির মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভগবান। কারাের তেজ কারাের কাছে তীব্রতার ত্যাগ হলেও সেই ত্যাগ অন্যের কাছে সুন্দর এবং শান্তির আশ্বাস পান করে। আর এসবের মূল মহানই হলেন তিনি।
(৬) আজও এই কালিমা মাখা কলিযুগে অধর্মের কলকাঠি ধর্মের তৃষ্ণায় নড়ে ওঠে। কাঠিটি আজও আমাদের মধ্যে বছরের এক মহা সন্ধিক্ষণে ধর্ম
তৃষ্ণার আবির্ভূত হয়। তাইতাে প্রতি বছরে শরতে আমাদের মধ্যে সেই মহাশুভ সন্ধিক্ষণের ধর্ম কাঠির বাজানাের তৃষ্ণা বেড়ে ওঠায় দেবদেবীর আশিষ
প্রাপ্যের প্রয়ােজনে সর্ব জাতির শ্রেষ্ঠ শারােৎসব ঢাক ঢোলের মধ্যে পড়া কাঠির শব্দে চারিদিকে আনন্দের ধারা বইয়ে দেয়। এবং আমাদেরই মধ্যে থাকা ধর্মের
তৃষ্ণায় কাঠিটি যখন নড়ে ওঠে। তখন বিভিন্ন জাতি একই আনন্দ ধারায় মেতে ওঠে। বিশ্বাস, অবিশ্বাস, সুখ, দুঃখ, কষ্ট যন্ত্রণা সবই ঐ কাঠির শব্দে বিলীন হয়ে
যায়। আর্থিক ক্ষুদ্রতা এবং বৃহত্তটাও সেদিন একই আনন্দ রেখায় বয়ে চলে। আর কল নড়ে ওঠার গল্পে বলি—এক জমিদারী বংশ ছিল আর সেই বংশের
একমাত্র উত্তরাধিকারী ছিল দাশু। এই দাশু যখন আঠারাে বছর বয়সের তখন তার বাবা যিনি সমস্ত জমিদারীর ধর্তা কর্তা তিনি মারা যান, ফলে জমিদারীর
সমস্ত হিসাব নিকাশের দায়ীত্ব পড়ে দাশুর উপর। দাশুর বয়স অল্প, সে এইসব ব্যাপারে আর কতটুকুই বা বােঝে। আর তার মা ছিলেন খুবই আস্তিক মানুষ।
তাই আন্তিকতা নিয়েই সব সময় ব্যস্ত থাকতেন। জমিদারির ব্যাপারটা ছেলের কাছ থেকে টেনে আনার চেষ্টাও করলেন না। ছেলে যা পারে তাই করুক এই
ভেবে তিনি দায়িত্বটাকে এড়িয়ে গেলেন। মা ধার্মিক থাকার ফলে ছেলেও ধার্মিকতার আবভাবটা অনেকটাই পেয়ে গেছে। কথায় আছে, যে বংশের যেমন
ধারা ভবিষ্যৎও সেই বংশকে তেমনভাবে তাড়া করে। কিন্তু দাশুর বাবা খুবই শক্ত মনের মানুষ ছিলেন বলেই জমিদারীটাকে খুব সুন্দরভাবে ধরে রেখেছিলেন।
অর্থ সম্পত্তি ধরে রাখা শক্তের পক্ষেই সম্ভব হয় এ যুগে নরমের পক্ষে তা ধরে রাখা এতটা সােজা নয়। তবুও দাশু বােঝা না বােঝার মধ্যে সে সবকে ধরে
রাখতে চাইলেও তার আশপাশের গােপন শত্রুরা তাকে ভাঙার চেষ্টায় তৈরী হতে লাগল। ছেলের এইসব দানের দয়া প্রবণতায় জমির কিছু অংশ বিলি হয়ে
গেল যাদের জমি তাদের কাছে। এইসব দেখে দাশুর মা ঠিক করলেন ভাল সৎ গুণী মেয়ে দেখে ছেলের বিয়ে দিয়ে দেবেন। এই ভাবনায় তাদের কর্মচারীর
গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ডেকে মেয়ে সন্ধানের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু তারা বদ মতলবের শত্রু ধরে এমন একটি মেয়ের সঙ্গে দাশুর বিয়ে দিলেন, যে বিয়েটার উদ্দেশ্য
ছিল সমস্ত সম্পত্তি নিজেদের কবলে আনা। দাশুর বিয়েটা বেশ ধুমধাম করে হয়ে গেল। বিয়ের কিছুদিন পরে তার মাও মারা যান। মা মারা যাওয়ায় দাশুর
আর বাঁদিক ডানদিকের কোন অস্ত্রই রইল না। যে রইল সে হল তার স্ত্রী এবং পশ্চাতের বিপদ। তার কর্মের সহচররা আত্ম মতলবের জন্য স্ত্রীর দ্বারা দাশুকে
বিভিন্ন পাগলের ওষুধ খাইয়ে আস্তে আস্তে তার কাছ থেকে সমস্ত সম্পত্তি লিখিয়ে নিল নিজের নামে। দাশুর স্ত্রী সমস্ত সম্পত্তি দাশুর কাছ থেকে লিখিয়ে
নিয়ে সে তার পুরানাে প্রেমিককে বিয়ে করে নিল। আর বেচারা দাশুর উপর খুব অত্যাচার করায়, সে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। দাশু ধার্মিক ঈশ্বর বিশ্বাসী। গ্রামের লোকেরা তাকে দেখতে পেলে কেউ কেউ খাবার দিত। কখনাে আবার কুকুর বিড়ালের প্রাপ্য খাবারও তাকে খেতে হত। সেইসব খাবারেই কাটত তার দিন। আর রাত কাটত কখনাে গাছের গােড়ায়। কখনাে কারাের গােয়াল ঘরে। বা কখনাে কারাের ঘরের দুয়ারে শুয়ে। তার আর এই গ্রামে থাকতে ভালােই লাগছিল না। বাড়িতে ফিরে
যাওয়ার ইচ্ছাটাও আর তার মাথায় খেলছিল না। যদিও বা খেলত 'তাহলে ঘরে গিয়ে মারধর খেয়ে ফিরে আসতে হত তাকে। তাই হয়তাে সেই খেলা ভগবান
তার মাথায় খেলননি সব কিছু ভাবনা চিন্তা করে। তার সেই পাগলামি মাথায়। শুধু একটাই খেলা খেলেছে যে সে কোন শহরের দিকে চলে যাবে। আগে সে
পুরানাে স্মৃতি মনে করে সে শহরের দিকে এগােতে পারবে। কিন্তু রেল বাসের শহরে প্রায়ই যেত তাই শহরে যাওয়ার রাস্তাটা আবছা আবছা মনে আছে।
ভাড়ার পয়সা তার কাছে নেই। এসব কিছুই হিসাব তার মস্তিষ্কের কোন অংশেই আচড় কাটে না। হাঁটাটাকে এগিয়ে যাওয়া মনে করে। শুরু করল শহরের দিকে
মুছতে সে হেঁটেই চলেছে শহরের দিকে। এইভাবে হাঁটতে হাঁটতে সে গ্রামের চলা। গরমের সময় দারুণ সূর্যের প্রখরতা, সেই তপ্ততার মধ্যে ঘাম মুছতে পথকে পেছনে রেখে শহরের পথে পা রাখে। আর একটা দিন হেঁটে পার করতে পারলেই সে পৌঁছে যাবে শহরে। তখন দুপুরবেলা দাশু ক্লান্তি মাখানাে দেহ নিয়েই হাঁটছে, পথে। আর মাত্র মাইল পাঁচেক পথ হাঁটলেই দাশু পৌঁছে
যাবে শহরে। কিন্তু এই পথটা পুরােপুরি উন্মুক্ত প্রান্তরের ন্যায়। ঘরবাড়ি দোকানপাটের কোন বালাই নেই দাশু হাঁটছে। ক্লান্তির অবসন্নতা তাকে পেছন থেকে টেনে
রাখলেও সে তাকে প্রতিহত করে এগিয়েই চলেছে।
জল পিপাসাও তার পেয়েছে। পথের এদিক ওদিক তাকালেও সে কোন পুকুর নালা দেখতেও পেল না। এদিকে অত্যধিক ঘামের জন্য শরীরের ভেতর
থেকে জল শূন্যতাও বেড়ে চলেছে। আর সেই শূন্যতার জন্য বাইরের থেকে পিপাসার টানটাও খুব বেড়ে চলেছে। তাই দাশুর আর পা চলে না তার পা
দুটিকে সে যতটুকুই এগােতে চায় তার অর্ধেকটা এগােয়। এইভাবে চলতে থাকলে তার শহরে পৌছানােটাই দুস্কর হয়ে উঠবে। সে শহরে পৌছাতে পারব বা না পারুক কিন্তু তার পিপাসার জন্য একটু জলের খুবই প্রয়ােজন। অনেকটা দূরে সে দেখতে পেল একটি কলের আকার আকৃতি। কিন্তু সেখানে তার
পোঁছানােটা খুবই কঠিন ব্যাপার। পিপাসায় তার গলা একেবারে শুকিয়ে এসেছে চোখেও সে যেন ঝাপসা দেখছে। ভগবানকে স্মরণ করে বলছে, হে ভগবান এ
কলটার কাছে আমাকে পৌঁছে দাও ঠাকুর। আসলে সে জানে না ঐ কলটা থেকে জল পড়ে কিনা। তখন তার একটাই বিশ্বাস যে ওখানে গেলে একটু না। একটু জল নিশ্চই পাবে এই আশায় সে বহু কষ্টে ঐ এটার কাছে পৌঁছালাে। এবং মন ভরা পিপাশা মেটানাে বিশ্বাসে কলটির হাতল ধরে নাড়ানাের সাথে সাথেই কলটি মাটিতে পড়ে গেল। এবং তার মুখ থেকে কিছু লাল রংয়ের জল বেরিয়ে যেতে লাগল। লাল, কি কালাে, সাদা কি বেগুনী এসব দাশুর কাছে বিচার করার সময় ছিল না। সে এইটুকুই বুঝল যে জল বেরােচ্ছে, সে দু’হাতে। ঐ লাল গন্ধযুক্ত জলটাকে পান করে কঠিন পিপাসা মেটালাে, তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাস।
ফেলে সে বলল হে ভগবান আমায় বাঁচালে নইলে মরেই যেতাম। তার জলের তৃষ্ণা মেটার সঙ্গে সঙ্গে মিটল তার অধ-বিকৃত মস্তিস্কের পাগলামােটাও। সে
সমস্ত শরীরে যেন কেমন একটা শান্তির আভাস খুজে পেল। কলটা আসলে বহুদিনের পুরানাে, হয়তাে আগে সেখানে কোন দোকানপাট ছিল। দোকান উঠে
যাওয়ায় কলটা আর ওঠেনি ওখানেই থেকে যায়। কলটির নিচের পাইপ মরচে পড়ে পুরোপুরি অক্ষয় হয়ে গেছিল তবুও সে কোন আঘাত পায়নি বলেই
২৫
ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল। দাশুর পিপাশার আঘাতেই কলটির অঙ্গভঙ্গ হল এবং দাশুও তার জীবন শেষের অংশটাকে ফিরে পেল। কলের জ্বলটা আসলে পাতাল
থেকে উঠে আসেনি। বৃষ্টির জলটাই ওপরের ছিদ্র দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে জমে ছিল। হয়তাে দাশুর পিপাসা মেটানাের জন্য, কিংবা সে যে ধার্মিক ছিল
অনেক অন্যায় অত্যাচারে শূন্য হস্তে সে নিজেকে হারানাের পথে ঠেলে দিয়েছিল। তাই ঈশ্বর তার ধার্মিকতার মর্যাদা দানের জন্য একই পিপাসায় দুটি সমস্যার সমাধান করলেন আর এটাই হল অধর্মের কল ধর্মের তৃষ্ণায় নড়ে ওঠা। দাশুর পাগলামাে ভালাে হয়ে গেলেও সে সেদিন শহরেই পৌঁছেছিল। এবং আস্তে
আস্তে করে সে নিজেকে শহরেই সাজিয়ে গুছিয়ে নিল।
(৭) একটি ছেলে সে অফিসে চাকরী করে। সে ঐশরীক ধর্মীয় শক্তিকে
বিশ্বাস করে না, কর্মকেই বিশ্বাস করে। কর্ম জীবনে বড় সত্য এটা ঠিক কিন্তু সব কর্মের পিছনে ধর্মের সূচনাটাও জড়িয়ে থাকে। এটা সে মানার প্রয়ােজন
বােধ না করেই চলতে থাকে, কাজের মাধ্যমে কখনাে তার ছােটখাটো বিপদ আসে তবু সে অর্থের দ্বারা সেগুলিকে সরিয়ে দেয়। রােজই সে সারাদিনে দশ
বিশ টাকার ধুয়াে ফেঁাকে। অফিস ছুটি হবার পর রােজই সে সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে থাকে ট্রেন ধরার জন্য। পথে অনেক ভিখারীরা তার কাছে হাত পাতলেও
সে সেই পাতা হাতটা না দেখার ভান করে চলতে থাকে। কখনাে কখনাে খুচরাে পয়সায় পকেটটা যদি ভারী থাকে তাহলে পঞ্চাশ পয়সা না হলে এক
টাকা অবরে সরে দান করে। একদিন সে অফিস ছুটি হবার পর স্টেশনে যাচ্ছে। পকেটে মাত্র দুটি টাকা আছে। এটা দিয়ে সে একটি সিগারেট কিনে
টানতে টানতে যাবে। এ দুটি টাকা তার মনের গভীরে বড়ই মূল্যবানের সম্পদ। সে দুটি টাকা হাতে নিয়ে সামনের দোকান থেকে সিগারেট কিনবে ওরই মধ্যে
এক ভিক্ষুক হাত বাড়িয়ে বলে কিছু দয়া করুন বাবু। ছেলেটির নেশার পরিপূর্ণ আশা কোথায় যেন বিলীন হয়ে তার হাতে থাকা দুটি টাকা সে সামনের পাতা
হাতটাতে দান করে দিল। দেবার পর সে তার নেশার জন্য একটু অসন্তুষ্ট হল চলল অন্য দিকে। ইচ্ছাশক্তির ভগবান ভিক্ষুকের প্রতিই ছিল বেশি দয়াশীল
ঠিকই। কিন্তু বিনা ধোয়ার টানেই সে বাড়ি ফিরল ভিক্ষুকটিও বেশ প্রসন্ন হয়ে তাই দাতার তীব্র ইচ্ছাটাকে ব্যাহত করে ভগবান নিজ শক্তির দ্বারা ভিক্ষুকের
প্রাপ্যটাকে জয়ী করালেন।
(৮) শহরের আর সব বাড়ির মতন এক গৃহস্থের বাড়িও রাস্তার ধারেই। এই বাড়ির কর্তা মনের দিক দিয়ে বেশ ট্যারা বাকা। কিন্তু গিন্নি বেশ ধার্মিক।
রাস্তার ধারে বাড়ি তার ফলে গাড়ি চলার জন্য পথের বহু ধূলা-বালি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। গিন্নি তাকে সময় মতাে রােজই পরিষ্কার করেন। এই ধুলাের
জন্য কর্তার কাছে অনেক বকুনিও শুনতে হয় গিন্নিকে। এইভাবে কর্তা গিন্নি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে দিন কাটান। এক ছুটির দিন তাদের ঘরে দুজন
আঞ্জীয় এসে হাজির হন। দুপুরের খাবারের জব্বর বন্দোবস্ত, রাস্তার দিকেই রান্নাশালটা। গিন্নি ভাতের হাঁড়ি বসিয়ে চাল দিয়ে ঢাকনা না লাগিয়ে অন্য
কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছেন। গাড়ির হাওয়ায় রাস্তায় ধুলাে বালির সঙ্গে চুল উড়ে এসে ভাতের হাঁড়ির মধ্যে পড়ে দিব্যি 'ভাতের সঙ্গে পাকাচ্ছে। কিছুক্ষণের পর
ভাত হয়ে যাওয়ায় ফেন ঝড়িয়ে তাকে খাবারের স্থানে এনে রাখলেন। তারপর মধ্যাহ্ন ভােজনে সকলকে ভাত বেড়ে দিলেন। কিন্তু কর্তার ভাতের থালার মধ্যে
চুল বেরিয়ে পড়ায় কর্তা সঙ্গে সঙ্গে ভাতের থালাটা সরিয়ে দিলেন। লােকেরবসামনে বলে গিন্নিকে বেশি কিছু বললেন না। গিন্নি পুণরায় ঐ একই হাঁড়ি
থেকে ভাত বেড়ে দেওয়ায় তিনি শান্তি করে খেয়ে নিলেন। গিন্নি ঐ চুলটাকে ফেলে ভাতটা খেলেন। আমরা সকলে শিক্ষিত, সব জানি বুঝি তবু আমরা
আসল সত্যকে আসল বলে মানি না। তাই তাে নিজের প্রাপ্যের জিনিসকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে। আবার তাকে একটি করে কুড়িয়ে এনে নিজেদের মান মর্যাদা
বাঁচাতে চাই।
(৯) ধর্ম সত্য না কর্ম সত্য?
 তার আসলত্যটা কারাের মধ্যেই স্থান পায় না। আমরা কতক ভাবি ধর্ম সত্য। আবার কতক ভাবি কর্ম সত্য। বিশ্বাসে ধর্ম সত্য
হলেও আসলে কর্মই হল আসল সত্য। কর্মের হাত ধরে আপন মানবিকতার দ্বারাই ধর্মের সততা লাভ করা যায়। কিন্তু ধর্মকে ভালােবেসে নিজের আন্তরিকতাকে
শান্তি দান করলেও, বাস্তব জগতে উন্নতির পরিকাঠামােকে গড়ে তােলা যায়না, তারই এক দৃষ্টান্তে বলি। এক ভদ্রলােক বাড়ি তার আসানশােলের ঐ দিকে। লােকটি আমার মনিবের কাছে বছরে বেশ কয়েকবারই আসেন গুরুদেব হিসাবে।
এবং মনিবের কাছ থেকে মন ভরা অর্থ সাহায্য নিয়ে চলে যান। এই আসা , যাওয়া এবং টাকাপয়সার ব্যাপারটা আমার মধ্যে একটা প্রশ্নের ভাবনা জাগিয়ে
ছিল। সেই প্রশ্নের উত্তর মনিবের কাছে জানতে চাওয়ায় তিনি বললেন লােকটির একসময় অনেক সম্পত্তি ও জায়গা জমি ছিল। কিন্তু লােকটি স্বভাবে নির্মা
তাই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে আস্তে আস্তে সমস্ত জমি জায়গা বিক্রি করতে ভরান। থাকেন কিন্তু ধর্ম কি আর পারে কর্মের সিংহাসনে বসতে। বরং কর্মের সিংহাসনে
বসে ধর্মের সিংহাসন গড়ে তােলা যায়, তাই সে পারেনি নিজেকে গড়ে তুলতে। বরং নিজের ভবিষ্যতকে আস্তে আস্তে ভেঙে নিজেকেই সে নিঃস্ব করে তুলছে।
বর্তমান তিনি ধর্মাশ্রমের নামে সাহায্য প্রার্থনা করে নিজের শূন্য উদরাশ্রমটাকেই
আমরা সকলে সকাল থেকে সন্ধ্যে দেবদেবীর মন্দিরে দুটাকা, পাঁচ টাকা দশ টাকা দান করে। আপন আপন বিপদ আপদ সুখ শান্তির কত কাকুতি মিনতি করে প্রার্থনা করি। আর বলি আমাকে ভালো  রাখো। আমার সন্তানকে পরিবারকে ভালাে রাখ। আমাকে উন্নতির পথ দেখাও। সে পথ সত্যের হােক বা মিথ্যের তাতে কোন কিছু যায় আসে না। আমার উন্নতি হলে,
আমি তােমাকে আরাে বেশি অর্থের ভােগ চড়াবাে। আর যদি অবনতি হয় তাহলে এক টাকারও বাতাসা দেব না। এ যুগে আমরা এমনই এক স্বার্থ লােভী আত্মবিশ্বাসী মানুষ যে নিজের দিকটাই সব সময় দেখে চলি। কোনদিন কেউ দেবদেবীর সামনে দাঁড়িয়ে বলি না হে ঠাকুর তােমরা ভালাে থেকো। একবারও বলি না এই দান শুধু তােমাদের জন্য এর বিনিময়ে আমাদের কিছু চাই না। তবুও তাঁরা নির্বাক মূর্তি হলেও আমাদের চাওয়ার কোন না কোন দিন অবশ্যই পুরণ করেন। কিন্তু আমরা বর্তমান আত্ম সত্যকে এতই ভালােবেসে ফেলেছি। যে নিজের মা বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে ভুলে যাই যে কেমন আছাে কি খেয়েছে। দেব মূর্তি তাে শুধু আরাধনার। বিশ্বাসের এবং আত্ম গঠনের। আর
নিজেদের মা বাবা তাে নিজেদেরকে গড়ে তােলার আসল পরিকাঠামাে। আর এই পরিকাঠামােকেই যদি অবজ্ঞা করি তাহলে কেমন করে আমরা দেবদেবীর
কাছে মঙ্গল প্রার্থনা পাব। প্রত্যেকের আরাধনার ঈশ্বর প্রত্যেকের অন্তরেই বসবাস করেন। শত কর্ম এবং ভালােবাসার দ্বারা ঈশ্বরকে জাগাও সেই জাগরণের
উক্তিই তােমাদের মঙ্গল কাম্য একদিকে যেমন শিশুদের মধ্যে লুকিয়ে থাকেন আরাধনার ঈশ্বর অন্যদিকে তেমনি বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের মধ্যেও লুকিয়ে থাকেন সত্যের
ঈশ্বর। তাই কোন সাময়িক সমস্যার সম্মুখীন হলে যে যার আরাধনার ঈশ্বরকে স্মরণ করে। কথা বলতে পারা শিশুকে বা অতি বৃদ্ধ মা বাবাকে জিজ্ঞাসা করলে
সেই সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায়।
(১১) আমরা মানব এটা সত্য। একশত বছরের যাত্রী এই প্রকৃতির বুকে এটাও সত্য। তবু নিজের দিকটা আমার গােপনভাবে ভাবি বলেই একই প্রকৃতির
মধ্যে থাকা বৃক্ষের মত কেউ দীর্ঘায়ুর অধিকারী হতে পারি না। কারণ বৃক্ষ সত্য , জ্ঞানী, বিশ্বাসী, আত্মত্যাগী প্রয়াস ধর্মী। আর আমরা বৃক্ষের গুণের একটিকেও
পালন করতে পারি না। তাইতাে জীবন কালের শতেকের হাতও আমাদের ধরা যায় না। শুধু আমরাই পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকি না। বৃক্ষেরাও
বহু পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকে। যেমন শিকড় মাটির সঙ্গে লড়াই করে জল শােষন করে উর্দ্বাংশের শরীরে সরবরাহ করে। পাতা-সূর্যরশ্মিকে
ধারণ করে খাদ্য প্রক্রিয়া করণ করে সমস্ত শাখাপ্রশাখাগুলি ঝড়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজের অস্তিত্বকে বজায় রাখে। এত লড়াইয়ের পরও তারা হার মানে না। নিজেদেরকে প্রকৃতির বুকে ধরে রেখে ছায়া দান করে। দান করে ফুল ফল শাখা প্রশাখা এমনকি সমস্ত দেহ। এত কিছু পাওয়ার পরও আমরা তাদেরকে কত ভাবেই আঘাত করি। তার শরীরে ছেদন করে রক্ত ঝরাই। কেউই বুঝি না তার ব্যথা বেদনার কষ্টটাকে। কিন্তু আমাদের শরীর থেকে একফোটা রক্ত
করলেই চারিদিকে হৈ চৈ ও ছােটাছুটি পরে যায়। আমাদের মতন তাদেরও কষ্ট হয় এবং ব্যথাও পায়। শুধু তারা নির্বাক বলে আমাদের অত্যাচারের কোন
প্রতিবাদ করতে পারে না। আমরা প্রত্যেকে চেষ্টা করলে তাদের আদর্শ ও গুণাবলিকে শ্রাদ্ধ্যমত নিজেদের মনের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে পারি গড়ে তুলতে পারি বৃক্ষের ন্যায় অনেকটাই সমতুল্য।
(১২) বিবেকানন্দকে অনুসরণ করে আমিও বলি তােমরা জাগাে জাগার মতাে জাগাে, জাগার মধ্যেই জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানাের আসলতা লুকিয়ে থাকে।
শুধু বিছানায় শুয়ে চোখ খােলা রেখে গড়াগড়ি খেতে খেতে সামনের পড়ে থাকা দিনগুলাের স্বপ্ন দেখাকেই জেগে থাকা বলে না। মনের জোরে শয্যা ত্যাগ।
করে বাইরে বেরিয়ে সময়ের সঙ্গে নিজেকে ছুটিয়ে আসল সত্ত্বার হাত ধরাটাকেই বলে জেগে থাকা বা জেগে ওঠা। আমার সকলেই আমাদের আশ-পাশ, সামনে, পিছনে ঘরে বাইরে এমনকি শরীরের মধ্যে জড়িয়ে রাখা সব কিছুকেই খুব কাছের এবং নিজের বলে মনে করি। নিজের ইচ্ছাপূরণের জন্য যখন যেটাকে কাছে না পাই তখন সেটার উপর বা সেইটাকে ধরে রাখা কারাের উপর একটা বিতৃষ্ণার সৃষ্টি হয় আর সেই বিতৃষ্ণার দ্বারাই শুরু হয় ঝগড়া বিবাদের।
 ঝগড়া থেকেই শুরু হয় মারামারি, কাটাকাটি, খুনােখুনি এবং এইভাবেই ভালােবাসার মৃত্যু হয়। শুরু হয় অশান্তি। সৌন্দর্য্যের মধ্যে নেমে আসে একটি কালাে ছায়া । আর সেই ছায়ার সঙ্গে হিংসা অহঙ্কার মিশে বেড়ে যায় অন্ধকারের গাড়িটা । কিন্তু বাস্তব জগতে যেমন বিজ্ঞান আছে তেমনই আছে জন্ম মৃত্যু। এবং ধর্মের যে যার আরাধনার ঈশ্বর এবং কর্মের সৎ চেষ্টা। আসলে এই প্রকৃতির কাছে আমাদের বলে কিছুই নেই। সবই নিয়ম আর সময়ের দ্বারা পালিত। জন্মে যা
কিছু আমরা এই প্রকৃতি থেকে গ্রহণ করি মৃত্যুর দিনে সব কিছুকেই রেখে থাকে না। সেও একদিন অন্যের কাছে হস্তান্তর হয়ে যায়। আর গােপনে জমিয়ে
যেতে হয় এই প্রকৃতির বুকে। এমন কি নিজের উপার্জিত অর্থ নিজের পকেটে রাখলে তার আসলত্যটা নষ্ট হয়ে ব্যবহারের অযােগ্য হয়ে যায়। তাই কোন
কিছুকেই অতিরিক্ত নিজের মনে না করে এগিয়ে যাওয়াকেই বলে সৎ সন্ধানী গড়ে নেয় এবং নিজের অতিরিক্ত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই ঊর্ধ্বগামী হওয়ার সাথে
মানুষের পরিচয়। বৃক্ষ তখনই তার ডালপালা প্রসারিত করে যখন সে নিজেকে। সাথে প্রসারিত করে ডালপালা বা শাখাপ্রশাখা ঠিক মানুষও তার প্রতিকৃতি গড়ে
তােলার জন্য লড়াইয়ের পর লড়াই করে আগে নিজেকে গড়ে তােলে। তারপর অন্যকে গড়ে তােলার চেষ্টা করে। জীবনের কোন অংশই নিজেকে না গড়ে
অন্যকে গড়ে তুলতে পারে না। চেষ্টার দ্বারাই কর্মের হাত ধরা এবং কর্মের হাত ধরেই জীবনে এগিয়ে যাওয়া তাই এক কথায় বলি কর্মের হাত ধরেই ধর্মের শীর্ষস্থানে পৌঁছানাে যায়, কিন্তু ধর্মের হাত ধরে কখনই কর্মের শীর্ষস্থানে পৌঁছানাে যায় না। বিশ্বাস, ভালােবাসা, সততা, এসবের মধ্যেই পাওয়া যায় কর্ম এবং
ধর্মের আসল আদর্শগুলি, মানবিকতার বিচারেই গড়ে ওঠে মানবিতা বােধ। তাই আপন আপন বােধশক্তি দ্বারাই নিজের সমস্ত ক্রিয়াকলাপকে উচ্চস্থানে আসীন
করা। সমস্ত জীবনের মধ্যেই খেলা করে অর্থ, সম্পদ, প্রাচুর্য্যতা। আর এসব যুগের হাত ধরেই থেকে যায় একের পর এক আগত জীবনের জন্য এবং
প্রকৃতির বুকে ফুটে ওঠা জীবন কুসুমটি কুড়ি থেকে ফুল হয়ে বর্ণ আকৃতি ধারণ করে সময়ের সাথে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখে আস্তে আস্তে ঝরে পড়ে মৃত্যুর
মুখে। এক জীবনের মধ্যে অনেক মতের আবির্ভাব হয়। এবং সেই ভিন্নমতের সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ভিন্ন পথও। আর সেই পথের কিছু পথকে দেখে
আমরা পা বাড়িয়ে এগিয়ে যেতে পারি অনেক অনেক সুন্দর সুযােগ সুবিধার দিকে। আবার অনেক পথকে আমরা ঠিকঠাকভাবে বুঝতে না পেরে এগিয়ে
যাওয়ার শুরুতেই শেষ পথকে হেয় করে নিজের আগামীর গতিপথকে থামিয়ে রাখি। আমাদের মধ্যে উথিত বিশ্বাস কখন আমাদেরকেই এগিয়ে নিয়ে যায়
ভালাের লক্ষ্যে, আবার কখন পিছিয়ে দিয়ে ফেলে রাখে আপন আপন আঁধার কক্ষে। তাই আগে নিজেকে বন্ধুর মত গড়ে তােল তারপর সামনে পিছনের সমস্ত কিছুকে বন্ধুর মর্যাদা দান কর। তােমার দানের শুরুর হাত ধরেই বিস্তার হয় বন্ধুত্বের বিজয় তােরণ যা সময় অনুসারে সকলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আস্থা যােগায়।।


..........................Life History........................  

No comments:

Powered by Blogger.