কর্ম বা কার্য দ্বারা মুক্তি : কর্তব্য বুদ্ধি : Swami Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History

কর্ম বা কার্য দ্বারা মুক্তি: Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা দ্বিতীয় পাঠ  : Life History 
কর্ম বা কার্য দ্বারা মুক্তি: Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History
Swami  Vivekananda 

এই কর্তব্য এই কর্তব্যবুদ্ধি গ্রীষ্মকালের মধ্যাহ্ন-সূর্য; উহা মানুষের অন্তরাত্মাকে দগ্ধ করিয়া দেয়। এইসব কর্তব্যের হতভাগ্য ক্রীত দাসদের দিকে ঐ চাহিয়া দেখ কর্তব্য-বেচারাদের ভগবানকে ডাকিবার অবকাশটুকুও দেয় না, স্নানাহারের সময় পর্যন্ত দেয় না! কর্তব্য যেন সর্বদাই তাহাদের মাথার উপর ঝুলিতেছে। তাহারা বাড়ির বাহিরে গিয়া কাজ করে, তাহাদের মাথার উপর কর্তব্য! তাহারা বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া আবার
পরদিনের কর্তব্যের কথা চিন্তা করে ; কর্তব্যের হাত হইতে মুক্তি নাই! এতাে ক্রীতদাসের জীবন অবশেষে ঘােড়ার মতাে গাড়িতে জোতা অবস্থায় ক্লান্ত
অবসন্ন হইয়া পথেই পড়িয়া গিয়া মৃত্যুবরণ। কর্তব্য বলিতে লােকে এইরূপই বুঝিয়া থাকে। অনাসক্ত হওয়া, মুক্ত পুরুষের ন্যায় কর্ম করা এবং সমুদয় কর্ম
ঈশ্বরে সমপণ করাই আমাদের একমাত্র প্রকৃত কর্তব্য। আমাদের সকল কর্তব্যই ঈশ্বরের। আমরা যে জগতে প্রেরিত হইয়াছি, সেজন্য আমরা ধন্য। আমরা আমাদের নির্দিষ্ট কর্ম করিয়া যাইতেছি; কে জানে, ভাল করিতেছি কি মন্দ করিতেছি ভালভাবে কর্ম করিলেও আমরা ফল ভােগ করিব না, মন্দভাবে করিলেও চিন্তাথিত হইব না। শান্ত ও মুক্তভাবে কাজ করিয়া যাও। এই মুক্ত অবস্থা লাভ করা বড় কঠিন। দাসত্বকে কর্তব্য বলিয়া, দেহের প্রতি দেহের অস্বাভাবিক আসক্তিকে কর্তব্য বলিয়া ব্যাখ্যা করা কত সহজ ! সংসারে মানুষ টাকার জন্য বা অন্য কিছুর জন্য সংগ্রাম করে চেষ্টা করে এবং
আসক্ত হয়। জিজ্ঞাসা কর কেন তাহারা উহা করিতেছে, তাহারা বলিবে, ইহা আমাদের কর্তব্য। বাস্তবিক উহা কাঞ্চনের জন্য অস্বাভাবিক তৃষ্ণামাত্র। এই তৃষ্ণাকে তাহারা কতকগুলি ফুল দিয়া ঢাকিবার চেষ্টা করিতেছে।
তবে শেষ পর্যন্ত কর্তব্য বলিতে কি বুঝায় উহা কেবল দেহ-মনের আবেগ-আসক্তির তাড়না। কোন আসক্তি বদ্ধমূল হইয়া গেলেই আমরা তাহাকে কর্তব্য বলিয়া থাকি। দৃষ্টান্তস্বরূপ  যে সব দেশে বিবাহ নাই, সে সব
দেশে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন কর্তব্যও নাই। সমাজে যখন বিবাহ প্রথা প্রচলিত থাকার পর এক বাস করা রীতিতে পরিণত হয়, তখন উহা কর্তব্য হইয়া
হয়, তখন স্বামী ও স্ত্রী আসক্তিবশতঃ একত্র বাস করে। পুরুষানুক্রমে এরূপ দাড়ায়। বলিতে গেলে ইহা একপ্রকার পুরাতন ব্যাধি। রােগ যখন প্রবলাকারে
দেখা দেয়, তখন উহাকে ব্যারাম' বলি; যখন উহা স্থায়ী দাড়াইয়া যায় , উহাকে আমরা স্বভাব' বলিয়া থাকি। যাহাই হউক, উহা রােগমাত্র। আসক্তি যখন প্রকৃতিগত হইয়া যায়, তখন উহাকে 'কর্তব্যরূপ” আড়ম্বরপূর্ণ নামে
অভিহিত করিয়া থাকি। আমরা উহার উপর যুল ছড়াইয়া দিই, তদুপলক্ষে তুরীভেরীও বাজানাে হয়, উহার জন্য শাস্ত্র হইতে মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়।
তখন সমগ্র জগৎ ঐ কর্তব্যের অনুরােধে সংগ্রামে মত্ত হয়, এবং মানুষ পরস্পরের দ্রব্য আগ্রহ সহকারে অপহরণ করিতে থাকে। কর্তব্য এই হিসাবে কতকটা ভাল যে, উহাতে পশুভাৰ কিছুটা সংযত হয়।
যাহারা অতিশয় নিম্নাধিকারী, যাহারা অন্য কোনরূপ আদর্শ ধারণা করিতে পারে না, তাহাদের পক্ষে কর্তব্য কিছুটা ভাল বটে; কিন্তু যাহারা কর্মযােগী। হইতে ইচ্ছা করেন, তাহাদিগকে কর্তব্যের ভাব একেবারে দর করিয়া দিতে হইবে। তােমার আমার পক্ষে কোন কর্তব্যই নাই। জগৎকে যাহা দিবার আছে অবশ্যই দাও, কিন্তু কর্তব্য বলিয়া নয়। উহার জন্য কোন চিন্তা করিও না। বাধ্য হইয়া কিছু করিও না। বাধ্য হইয়া কেন করিবে? বাধ্য হইয়া যাহা কিছু কেন কর, তাহা দ্বারাই আসক্তি বধিত হয়। কর্তব্য বলিয়া তােমার কিছু থাকিবে' সবই ঈশ্বরে সমপণ কর।' এই সংসার-রূপ ভয়ঙ্কর অগ্নিময় কটাহে যেখানে কর্তব্যরূপ অনল সকলকে দক্ষ করিতেছে, সেখানে এই অমৃত পান।
করিয়া সুখী হও। আমরা সকলেই শুধু তাহার ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করিতেছি, ইচ্ছা কর, তবে তাহার সহিত তােমাকে শাস্তিও লইতে হইবে। শাস্তি পুরস্কার বা শান্তির সহিত আমাদের কোন সম্পর্ক নাই। যদি পুরস্কার পাইতে এড়াইবার একমাত্র উপায় পুরস্কার ত্যাগ করা। দুঃখ এড়াইবার একমাত্র উপায় সুখের ভাবও ত্যাগ করা, কারণ উভয়ে একসূত্রে গ্রথিত। একদিকে
সুখ, আর একদিকে দুঃখ! একদিকে জীবন, অপরদিকে মৃত্যু। মৃত্যুকে অতিক্রম করিবার উপায় জীবনের প্রতি অনুরাগ পরিত্যাগ করা। জীবন ও
মৃত্যু একই জিনিস, শুধু বিভিন্ন দিক হইতে দেখা । অতএব ‘দুঃখশূন্য সুখ এবং 'মৃত্যুহীন জীবন' কথাগুলি বিদ্যালয়ের ছেলেদের ও শিশুগণের পক্ষেই
ভাল ; কিন্তু চিন্তাশীল ব্যক্তি দেখেন, বাক্যগুলি স্ববিরােধী, সুতরাং তিনি দুই-ই পরিত্যাগ করেন। যাহা কিছু কর, তার জন্য কোন প্রশংসা বা পুরস্কারের
আশা করিও না। ইহা অতি কঠিন। আমরা যদি কোন ভাল কাজ করি, অমনি তাহার জন্য প্রশংসা চাহিতে আরম্ভ করি। যখনই আমরা কোন চাদা দিই,
অমনি আমরা দেখিতে ইচ্ছা করি—কাগজে আমাদের নাম প্রচারিত হইয়াছে । এইরূপ বাসনা যা অবশ্যই দুঃখ। জগতের শ্রেষ্ঠ মানবগণ অজ্ঞতভাবেই
চলিয়া গিয়াছেন। যে-সকল মহাপুরুষের সম্বন্ধে জগৎ কিছুই জানে না, তাহাদিগের সহিত তুলনায় আমাদের পরিচিত বুদ্ধগণ ও খ্রীস্টগণ দ্বিতীয় শ্রেণীর ব্যক্তিমাত্র। এইরূপ শত শত ব্যক্তি প্রতি দেশে আবির্ভূত হইয়া নীরবে কাজ করিয়া গিয়াছেন। নীরবে তাহারা জীবন-যাপন করিয়া নীরবে চলিয়া যান; সময়ে তাহাদের চিন্তারাশি বুদ্ধ ও খ্রীস্টের মতাে মহামানবে ব্যক্তভাব
ধারণ করে। এই শেষােক্ত ব্যক্তিগণই আমাদের নিকট পরিচিত হন। শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষগণ তাহাদের জ্ঞানের জন্য কোন নাম-যশ আকতক্ষা করেন নাই। তাহারা জগতে তাহাদের ভাব দিয়া যান, তাহারা নিজেদের জন্য কিছু দাবি করেন না, নিজেদের নামে কোন সম্প্রদায় বা ধর্মমত স্থাপন করিয়া যান না। ঐরূপ করিতে তাহাদের সমগ্র প্রকৃতি সঙ্কুচিত হয়। তাহারা শুদ্ধসাত্তিক
তাহারা কখনাে কোন আন্দোলন সৃষ্টি করিতে পারেন না, তাহারা কেবল প্রেমে গলিয়া যান। আমি এইরূপ একজন যােগী দেখিয়াছি, তিনি ভারতে এক গুহায় বাস করেন। আমি যত আশ্চর্য মানুষ দেখিয়াছি, তিনি তাহাদের অন্যতম। তিনি তাহার ব্যক্তিগত আমিত্বের ভাব এমনভাবে বিলুপ্ত করিয়াছেন যে, অনায়াসেই বলিতে পারা যায়, তাহার মনুষ্যভাব একেবারে চলিয়া
গিয়াছে; পরিবর্তে শুধু ব্যাপক ঈশ্বরীয় ভাব তাহার হৃদয় জুড়িয়া রহিয়াছে। যদি কোন প্রাণী তাহার এক হাত দংশন করে, তিনি তাহাকে অপর হাতটিও
দিতে প্রস্তুত, এবং বলেন ইহা প্রভুর ইচ্ছা। যাহা কিছু তাহার কাছে আসে , তিনি মনে করেন সবই প্রভুর নিকট হইতে আসিয়াছে। তিনি লােকের সম্মুখে বাহির হন না, অথচ তিনি প্রেম সত্য ও মধুর ভাবরাশির অফুরন্ত ভাণ্ডার। তারপর অপেক্ষাকৃত অধিক রজঃশক্তিসম্পন্ন বা সংগ্রামশীল পুরুষগণের
স্থান। তাহারা সিদ্ধপুরুষগণের ভাবরাশি গ্রহণ করিয়া জগতে প্রচার করেন। শ্রেষ্ঠ পুরুষগণ সত্য ও মহান ভাবরাশি নীরবে সংগ্রহ করেন, এবং বুদ্ধ
খ্রীস্টগণ সেই সব ভাব স্থানে স্থানে গিয়া প্রচার করেন ও তদুদ্দেশ্যে কাজ করেন। গেীতম বুদ্ধের জীবন-চরিতে আমরা দেখিতে পাই, তিনি সর্বদাই নিজেকে পঞ্চবিংশ বৃদ্ধ বলিয়া পরিচয় দিতেছেন। তাহার পূর্বে যে চব্বিশ জন বুদ্ধ হইয়া গিয়াছেন, ইতিহাসে তাহারা অপরিচিত। কিন্তু ইহা নিশ্চিত যে, ঐতিহাসিক বুদ্ধ তাহাদের স্থাপিত ভিত্তির উপরই নিজ ধর্মপ্রাসাদ নির্মাণ করিয়া গিয়াছেন। শ্রেষ্ঠ পুরুষগণ শান্ত, নীরব ও অপরিচিত। তাহারা জানেন ঠিকঠিক চিন্তার শক্তি কতদূর। তাহারা নিশ্চিতভাবে জানেন, যদি তাহারা কোন গুহায় দ্বার বন্ধ করিয়া পাচটি সৎ চিন্তা করেন, তাহা হইলে সেই পাচটি
চিন্তা অনন্তকাল ধরিয়া থাকিবে। সত্যই সেই চিন্তাগুলি পর্বত ভেদ করিয়া, সমুদ্র পার হইয়া সমগ্র জগৎ পরিক্রমা করিবে এবং পরিশেষে মানুষের হৃদয়ে
ও মস্তিষ্কে প্রবেশ করিয়া এমন সব নরনারী উৎপন্ন করিবে, যাহারা জীবনে ঐ চিন্তাগুলিকে কার্যে পরিণত করিবে। পূর্বোক্ত সাত্ত্বিক ব্যক্তিগণ ভগবানের এত
নিকটে অবস্থান করেন যে, তাহাদের পক্ষে সংগ্রাম-মুখর কর্ম করিয়া জগতে পরােপকার, ধর্মপ্রচার প্রভৃতি কর্ম করা সম্ভব নয়। কর্মীরা যতই ভাল হউন না
কেন, তাহাদের মধ্যে কিছু না কিছু অজ্ঞান থাকিয়া যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের স্বভাবে একটু মলিনতা অবশিষ্ট থাকে, ততক্ষণই আমরা কর্ম
করিতে পারি-কর্মের প্রকৃতিই এই যে, সাধারণতঃ উহা অভিসন্ধি ও আসক্তি দ্বারা চালিত হয়। সদাক্রিয়াশীল বিধাতা চড়াই পাখিটির পতন পর্যন্ত লক্ষ্য করিতেছেন; তাহার সমক্ষে মানুষ তাহার নিজ কার্যের উপর এতটা গুরুত্ব আরােপ করে কেন? তিনি যখন জগতের ক্ষুদ্রতম প্রাণীটির পর্যন্ত খবর কর্তব্য সশ্রদ্ধ বিস্ময়ে তাহার সমক্ষে দণ্ডায়মান হইয়া বলা 'তােমার ইচ্ছাই।
রাখিতেছেন, তখন ঐরূপ করা কি একপ্রকার ঈশ্বরনিন্দা নয় আমাদের শুধু পূর্ণ হউক। সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবেরা কর্ম করিতে পারেন না, কারণ তাহাদের
মনে কোন আসক্তি নাই। যিনি আত্মাতেই আনন্দ করেন, আত্মাতেই তৃপ্ত, আত্মাতেই সন্তুষ্ট, তাহার কোন কার্য নাই। ইহারাই মানবজাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ,
ইহারা কার্য করিতে পারেন না, তাছাড়া প্রত্যেককেই কার্য করিতে হইবে । এইরূপ কার্য করিবার সময় আমাদের কখনাে মনে করা উচিত নয় যে,
জগতের অতি ক্ষুদ্র প্রাণীকেও কিছু সাহায্য করিতে পারি ; তাহা আমরা পারি উপকার করিয়া থাকি। কর্ম করিবার সময় এইরূপ ভাব অবলম্বন করাই
না। এই জগৎরূপ শিক্ষালয়ে পরােপকারের দ্বারা আমরা নিজেরাই নিজেদের কর্তব্য। যদি আমরা এইভাবে কার্য করি, যদি আমরা সর্বদাই মনে রাখি যে,
কম করতে সুযােগ পাওয়া আমাদের পক্ষে মহা সৌভাগ্যের বিষয়, তৰে ।
কর্ম বা কার্য দ্বারা মুক্তি: Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History
আমরা কখনো উহাতে আসক্ত হব না। তোমার আমার মতাে লক্ষ লক্ষ
মানুষ মনে করে, এ জগতে আমরা সব মস্ত লােক, কিন্তু আমরা সকলেই মরিয়া যাই, তারপর পাচ মিনিটে জগৎ আমাদের ভুলিয়া যায়। কিন্তু ঈশ্বরের জীবন অনন্ত-‘কো হ্যেবান্যাৎ কঃ প্রান্ত যদেষ আকাশ আনন্দ নস্যাৎ। যদি সেই সর্বশক্তিমান প্রভু ইচ্ছা না করিতেন, তবে কে এক মুহূর্তও বাচিতে পারি, কে এক মুহূর্তও শ্বাস-প্রশ্বাস ত্যাগ করিতে পারিব? তিনিই নিয়ত-কর্মশীল বিধাতা। সকল শক্তিই তাহার এবং তাহার আজ্ঞাধীন।
ভয়াদস্যাগ্নিস্তপতি ভয়াত্তপতি সূর্য।।
ভয়াদিন্দ্ৰশ্চ বায়ুশ্চ মৃত্যুধাবতি পঞ্চমঃ ॥২।
তাহার আজ্ঞায় বায়ু বহিতেছে, সূর্য কিরণ দিচ্ছে, পৃথিবী বিধৃত রহিয়াছে এবং মৃত্যু জগতে বিচরণ করিতেছে। তিনি সর্বেসর্বা ; তিনিই সব , তিনি সকলের মধ্যে ব্রাজিল। আমরা কেবল তাহার উপাসনা করিতে
পারি। কর্মের সমুদয় ফল ত্যাগ কর, সৎ কর্মের জন্য সৎ কর্ম কর, তবেই কেবল সম্পূর্ণ অনাসক্তি আসিবে। এইরূপে হৃদয়-গ্রন্থি ছিন্ন হইবে, এবং আমরা পূর্ণ মুক্তি লাভ করিব। এই মুক্তিই কর্মযোগের লক্ষ্য।


..........................Life History..........................   

No comments:

Powered by Blogger.