কর্ম রহস্য : Swami Vivekananda : বাণী ও রচনা : দ্বিতীয় পর্ব : Life History

কর্মরহস্য  :Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History 

কর্মরহস্য  :Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History
Swami  Vivekananda
কর্মরহস্য  :স্বামী বিবেকান্দ ভালবাসার মতাে দেখাইতেছে, বস্তুতঃ ইহা ভালবাসা নয়। উহা ভালবাসা হইতে পারে না, কারণ উহা যন্ত্রণাদায়ক। যদি মেয়েটি তাহার ইচ্ছা অনুযায়ী।
কাজ না করে, তবে তাহার কষ্ট হইবে। ভালবাসায় কোন দুঃখকর প্রতিক্রিয়া
নাই। ভালবাসার প্রতিক্রিয়ায় কেবল আনন্দই হইয়া থাকে। ভালবাসিয়া যদি আনন্দ না হয়, তবে উহা ভালবাসা নয় ; অন্য কিছুকে আমরা ভালবাসা
বলিয়া ভুল করিতেছি। যখন তুমি তােমার স্বামীকে, স্ত্রীকে, পুত্রকন্যাকে সমুদয় পৃথিবীকে, বিশ্বজগৎকে এমনভাবে ভালবাসিতে সমর্থ হইবে যে , তাহাতে কোনরূপ দুঃখ ঈর্ষা বা স্বার্থপরতার প্রতিক্রিয়া হইবে না, তখনই তুমি প্রকৃতপক্ষে অনাসক্ত হইতে পারিবে।
শ্রীকৃষ্ণ বলিতেছেন, 'হে অর্জুন, আমাকেই দেখ না, আমি যদি এক মুহূর্ত কর্ম হইতে বিরত হই, সমগ্র জগৎ ধ্বংস হইবে। কর্ম করিয়া আমার কোন লাভ নাই। আমিই জগতের একমাত্র প্রভু, তবে আমি কর্ম করি কেন জগৎকে ভালবাসি বলিয়া।১ ঈশ্বর ভালবাসেন বলিয়াই তিনি অনাসক্ত।
প্রকৃত ভালবাসা আমাদিগকে অনাসক্ত করে। যেখানেই দেখিবে আসক্তি পার্থিব বস্তুর প্রতি এই আকর্ষণ, সেখানেই জানিবে উহা প্রাকৃতিক আকর্ষণ, কতকগুলি জড়বিন্দুর সহিত আরও কতকগুলি জড়বিন্দুর ভৌতিক আকর্ষণ মাত্র কিছু যেন দুইটি বস্তুকে ক্রমাগত নিকটে আকর্ষণ করিতেছে ; আর উহারা পরস্পর খুব নিকটবর্তী হইতে না পারিলেই যন্ত্রণার উদ্ভব হয় ;
কিন্তু প্রকৃত ভালবাসা ভৌতিক বা শারীরিক আকর্ষণের উপর কিছুমাত্র নির্ভর করে না। এরূপ প্রেমিকগণ পরস্পরের নিকট হইতে সহস্র মাইল ব্যবধানে
থাকিতে পারেন, কিন্তু তাহাতে তাহাদের ভালবাসা অটুট থাকিবে, উহা বিনষ্ট হইবে না এবং উহা হইতে কখনাে কোন যন্ত্রণাদায়ক প্রতিক্রিয়া হইবে না।।
এই অনাসক্তি লাভ করা একরূপ সারা জীবনের সাধনা বলিলেও হয় , কিন্তু উহা লাভ করিতে পারিলেই আমরা প্রকৃত প্রেমের লক্ষ্যস্থলে উপনীত
হইলাম এবং মুক্ত হইলাম। তখন আমাদের প্রকৃতিজাত বন্ধন খসিয়া পড়ে । এবং আমরা প্রকৃতির যথার্থ রূপ দেখিতে পাই। প্রকৃতি আমাদের জন্য আর
বন্ধন সৃষ্টি করিতে পারে না ; আমরা তখন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে দাড়াইতে পারি এবং কর্মের ফলাফল আর গণ্য করি না। কি ফল হইল, কে তখন গ্রাহ্য
করে শিশু সন্তানদিগকে কিছু দিলে তােমরা কি তাহাদের নিকট হইতে কিছু প্রতিদান চাও তাহাদের জন্য কাজ করাই তােমার কর্তব্য ঐখানেই উহার
শেষ। কোন বিশেষ ব্যক্তি নগর বা রাষ্ট্রের জন্য যাহা কর, তাহা করিয়া যাও, কিন্তু সন্তানদের প্রতি তােমার যেরূপ ভাব উহাদের প্রতিও সেই ভাব অবলম্বন কর, উহাদের নিকট হইতে প্রতিদানস্বরূপ কিছু আশা করিও না ।যদি সর্বদা দাতার ভাব অবলম্বন করিতে পার, প্রত্যুপকারের কোন আশা না রাখিয়া জগৎকে শুধু দিয়া যাইতে পার, তবেই সেই কর্ম হইতে তােমার কোন
বন্ধন বা আসক্তি আসিবে না। যখন আমরা কিছু প্রত্যাশা করি, তখনই আসক্তি আসে।
যদি ক্রীতদাসের মতাে কাজ করিলে তাহাতে স্বার্থপরতা ও আসক্তি আসে, তাহা হইলে প্রভুর ভাবে কাজ করিলে তাহাতে অনাসক্তিজনিত আনন্দ
আসিয়া থাকে। আমরা অনেক সময় ন্যায়ধর্ম ও নিজ নিজ অধিকারের কথা বলিয়া থাকি, কিন্তু দেখিতে পাই এ-সংসারে ঐগুলি শিশুসুলভ বাক্য মাত্র।
দুইটি ভাব মানুষের চরিত্র নিয়ন্ত্রণ করিয়া থাকে ক্ষমতা ও দয়া। ক্ষমতা প্রয়ােগ চিরকালই স্বার্থপরতা দ্বারা চালিত হয়। সকল নরনারীই তাহাদের
শক্তি ও সুবিধা যতটা আছে, তাহার যতটা পারে তাহা প্রয়ােগ করিতে চেষ্টা করে। দয়া স্বর্গীয় বস্তু ; ভাল হইতে গেলে আমাদের সকলকেই দয়াবান হইতে হইবে। এমনকি ন্যায়বিচার এবং অধিকারবােধ দয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত। কর্মের ফলাকাঙক্ষাই আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রতিবন্ধক ; শুধু তাই নয়, পরিণামে ইহা দুঃখের কারণ হয়। আর এক উপায় আছে, যাহা দ্বারা এই দয়া
ও নিঃস্বার্থপরতা কার্যে পরিণত করা যাইতে পারে ; যদি আমরা সগুণ ব্যক্তিভাবাপন্ন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি, তবে কর্মকে ‘উপাসনা' বলিয়া চিন্তা করিতে হইবে। এক্ষেত্রে আমরা আমাদের সমুদয় কর্মফল বা কর্মরহস্য   ভগবানে অৰ্পণ করিয়া থাকি। এইরূপে তাহাকে উপাসনা করিলে আমাদের কর্মের জন্য মানবজাতির নিকট কিছু প্রত্যাশা করিবার অধিকার আমাদের নাই। প্রভু স্বয়ং সর্বদা কর্ম করিতেছেন এবং তাহার আসক্তি নাই। জল যেমন পদ্মপত্র ভিজাইতে পারে
না, ফলে আসক্তি উৎপন্ন করিয়া কর্ম তেমনি নিঃস্বার্থ ব্যক্তিকে বন্ধ করিতে পারে না। অহংশুন্য ও অনাসক্ত ব্যক্তি জনপূর্ণ পাপ-সঙ্কুল শহরের অভ্যন্তরে
বাস করিতে পারেন, তাহাতে তিনি পাপে লিপ্ত হইবেন না । এই সম্পূর্ণ স্বার্থত্যাগের ভাবটি এই গল্পটিতে ব্যাখ্যাত হইয়াছে কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের অবসানে পঞ্চপাণ্ডব এক মহাযজ্ঞ করিয়া দরিদ্রদিগকে
নানাবিধ বহুমূল্য বস্তু দান করিলেন। সকলেই এ-যাঞ্জের জাকজমক ও ঐশ্বর্যে চমৎকৃত হইয়া বলিতে লাগিল, জগতে পূর্বে এরূপ যজ্ঞ আর হয় নাই।
যজ্ঞশেষে এক ক্ষুদ্রকায় নকুল আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার অর্ধশরীর সােনার মতাে রঙ, বাকি অর্ধেক পিঙ্গল। নকুলটি সেই যন্ত্রভূমিতে গড়াগড়ি
দিতে লাগিল, এবং সেখানে উপস্থিত সকলকে বলিল, তােমরা সব মিথ্যাবাদী, ইহা যজ্ঞই নয়। তাহারা বলিতে লাগিল, “কি তুমি বলিতেছ ইহা
যজ্ঞই নয় তুমি কি জান না, এই যজ্ঞে দরিদ্রদিগকে কত ধনরত্ন প্রদত্ত হইয়াছে, সকলেই ধনবান ও সন্তুষ্ট হইয়া গিয়াছে ইহার মতাে অদ্ভুত যজ্ঞ
আর কেহ কখনাে করে নাই।' নকুল বলিল
শুনুন এক ক্ষুদ্র গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূসহ বাস করিতেন। ব্রাহ্মণ খুব গরিব ছিলেন ; শাস্ত্রপ্রচার ও ধর্মোপদেশ দ্বারা লব্ধ
ভিক্ষাই ছিল তাহার জীবিকা। সেই দেশে একদা পর পর তিন বৎসর দুর্ভিক্ষ হইল, গরিব ব্রাহ্মণটি পূর্বাপেক্ষা অধিকতর কষ্ট পাইতে লাগিলেন। অবশেষে
সেই পরিবারকে পাঁচ দিন উপবাসে থাকিতে হইল। সৌভাগ্যক্রমে সুষ্ঠ দিনে পিতা কিছু যবের ছাতু সংগ্রহ করিয়া আনিলেন এবং উহা চার ভাগ করিলেন।
তাহারা উহা খাদ্যরূপে প্রস্তুত করিয়া ভােজনে বসিয়াছেন, এমন সময় দরজায়
ঘা পড়িল। পিতা দ্বার খুলিয়া দেখিলেন যে, এক অতিথি পাড়াইয়া। ভারতবর্ষে অতিথি বড় পবিত্র ও মাননীয় ; সেই সময়ের জন্য তাহাকে
'নারায়ণ মনে করা হয় এবং তাহার প্রতি সেইরূপ আচরণ করা হয়। দরিদ্র ব্রাহ্মণটি বলিলেন, 'আসুন, মহাশয় আসন, স্বাগত!' ব্রাহ্মণ অতিথির সম্মুখে
নিজ ভাগের খাদ্য রাখিলেন। অতিথি অতি শীঘ্রই উহা নিঃশেষ করিয়া বলি আমি দশ দিন ধরিয়া উপবাস করিতেছি এই অল্প পরিমাণ খাদ্যে আমার
লেন, 'মহাশয়, আপনি আমাকে একেবারে মারিয়া ফেলিলেন দেখিতেছি । জঠরাগ্নি আরও জ্বলিয়া উঠিল! তখন ব্রাহ্মণী স্বামীকে বলিলেন, 'আমার
ভাগও উহাকে দিন।' স্বামী বলিলেন, 'না, তা হইবে না।' কিন্তু ব্রাহ্মণ পত্নী জোর করিয়া বলিতে লাগিলেন, “এ দরিদ অতিথি আমাদের নিকট উপস্থিত,
আমরা গৃহস্থ আমাদের কর্তব্য তাহাকে খাওয়ানাে, আপনার যখন আর কিছু দিবার নাই, তখন সহধর্মিণীরূপে আমার কর্তব্য তাহাকে আমার ভাগ
দেওয়া।' এই বলিয়া তিনিও নিজ ভাগ অতিথিকে দিলেন। অতিথি তৎক্ষণাৎ তাহা নিঃশেষ করিয়া বলিলেন, 'আমি এখনাে ক্ষুধায় জ্বলিতেছি।' তখন পুত্রটি বলিল, 'আপনি আমার ভাগও গ্রহণ করুন। পুত্রের কর্তব্য পিতাকে তাহার কর্তব্যপালনে সহায়তা করা। অতিথি তাহারও অংশ খাইয়া ফেলিলেন, কিন্তু
তথাপি তাহার তৃপ্তি হইল না। তখন পুত্রবধূও তাহার ভাগ দিলেন। এইবার তাহার আহার পর্যাপ্ত হইল। অতিথি তখন তাহাদিগকে আশীর্বাদ করিতে
করিতে চলিয়া গেলেন। সেই রাত্রে ঐ চারিটি লােক অনাহারে মরিয়া গেল। ঐ ছাতুর গুড়া কিছু
মেঝেয় পড়িয়াছিল। যখন আমি উহার উপরে গড়াগড়ি দিলাম, তখন আমার অর্ধেক শরীর সােনালী হইয়া গেল  আপনারা সকলে তাে ইহা দেখিতেছেন।
সেই অবধি আমি সমগ্র জগৎ খুঁজিয়া বেড়াইতেছি ; আমার ইচ্ছা যে এইরূপ আর একটি যন্ত্র দেখিব। কিন্তু আর সেরূপ যজ্ঞ দেখিতে পাইলাম না। আর
কোথাও আমার শরীরের অপরাধ সুবর্ণে পরিণত হইল না। সেইজন্যই আমি বলিতেছি, ইহা যজ্ঞই নয়।
ভারত হইতে এরূপ স্বার্থত্যাগ ও দয়ার ভাব চলিয়া যাইতেছে ; মহৎ ব্যক্তিগণের সংখ্যা ক্রমশঃ কমিয়া যাইতেছে ; নূতন ইংরেজী শিখিবার সময়
আমি একটা গল্পের বই পড়িয়াছিলাম। উহাতে একটি গল্প ছিল কর্তব্যপরায়ণ বালকের গল্প ; সে কাজ করিয়া যাহা উপার্জন করে। ধরিয়া বালকের এই কাজের প্রশংসা করা হইয়াছে। কিন্তু ইহাতে অসাধারণত্ব
তাহার কতকাংশ তাহার বৃদ্ধা জননীকে দিয়াছিল। বই-এর তিন-চার পৃষ্ঠা কি আছে? এই গল্প যে কি নীতি শিক্ষা দেয়, কোন হিন্দু বালকই তাহা
শুনিয়া আমি ব্যাপারটা বুঝিতে পারিতেছি এ দেশে এমন লােক অনেক ধরিতে পারে না। এখন পাশ্চাত্য দেশের ভাব-প্রত্যেকেই নিজের জন্য
আছে, যাহারা নিজেরাই সব ভােগ করে, বাপ-মা স্ত্রী-পুত্রদিগের একেবারে ভাসাইয়া দেয়। কোথাও কখনাে গৃহস্থের এরূপ আদর্শ হওয়া উচিত নয়।
এখন তােমরা বুঝিতেছ, কর্মযােগের অর্থ কি। উহার অর্থ মৃত্যুর সম্মুখীন হইয়াও মুখটি বুজিয়া সকলকে সাহায্য করা। লক্ষ লক্ষ বার লােক
তােমাকে প্রতারণা করুক, কিন্তু তুমি একটি প্রশ্নও করিও না, এবং তুমি যে কিছু ভাল কাজ করিতেছ, তাহা ভাবিও না। দরিদ্রগণকে তুমি যে দান
করিতেছ, তাহার জন্য বাহাদুরি করিও না, অথবা তাহাদের নিকট হইতে কৃতজ্ঞতা আশা করিও না, বরং তাহার যে তোমাকে তাহাদের সেবা করিবার।
সুযোগ দিয়েছে, সেই জন্য তাহাদের প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অতএব স্পষ্ট দেখা যাইতেছে, আদর্শ সন্ন্যাসী হওয়া অপেক্ষা আদর্শ গৃহী হওয়া কঠিন। যথার্থ ত্যাগীরা জীবন অপেক্ষা যথার্থ কর্মীর জীবন কঠোরতর না হলেও সত্যি সমভাবে কঠিন।

Life history more... 



...........................Life History........................

No comments:

Powered by Blogger.