কর্ম বা কার্য দ্বারা মুক্তি : Swami Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History

কর্ম বা কার্য দ্বারা মুক্তি: Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা প্রথম পাঠ  : Life History 
কর্ম বা কার্য দ্বারা মুক্তি: Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History
Swami  Vivekananda

আমরা পূর্বেই বলিয়াছি, ‘কার্য এই অর্থ ব্যতীত কর্ম’-শব্দ দ্বারা মনোবিজ্ঞানে কার্য কারণ ভাবে বুঝিয়ে থাকে। যে কোন কার্য বা যে কোন চিন্তা কোন কিছু ফল উৎপন্ন করে, তাহাকেই ‘কর্ম বলে। সুতরাং । কর্মবিধানের অর্থ কার্য-কারণের নিয়ম অর্থাৎ কারণ ও কার্যের অনিবার্য। সম্বন্ধ। আমাদের (ভারতীয়)দর্শনের মতে এই কর্মবিধান সমগ্র বিশ্বজগতের পক্ষেই সত্য। যাহা কিছু আমরা দেখি, অনুভব করি, অথবা যে-কোন কাজ করি বিশ্বজগতে যাহা কিছু কাজ হইতেছে সবই একদিকে পূর্বকর্মের ফলমাত্র, আবার অপর দিকে এগুলিই কারণ হইয়া অন্য ফল উৎপাদন করে। এই সঙ্গে বিচার করা আবশ্যক ‘বিধি” বা “নিয়ম” বলিতে কি বোঝায়। ঘটনাশ্রেণীর পুনরাবর্তনের প্রবণতার নামই নিয়ম বা বিধি। যখন আমরা দেখি, একটি ঘটনার পরেই আর একটি ঘটনা ঘটিতেছে, কখনাে বা
ঘটনা-দুইটি যুগপৎ ঘটিতেছে, তখন আমরা আশা করি, সর্বদাই এরূপ ঘটিবে। আমাদের দেশের প্রাচীন নৈয়ায়িকগণ ইহাকে ‘ব্যাপ্তি” বলিতেন।
তাহাদের মতে, নিয়ম সম্বন্ধে আমাদের সমুদয় ধারণার কারণ অনুষঙ্গ। ঘটনাপরম্পরা আমাদের মনে অনুভূত বিষয়গুলির সঙ্গে অপরিবর্তনীয়ভাবে
জড়িত থাকে। সেইজন্য যখনই আমরা কোন বিষয় অনুভব করি, তখনই মনের অন্তর্গত অন্যান্য বিষয়গুলির সহিত ইহার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। একটি
ভাব অথবা আমাদের মনােবিজ্ঞান অনুসারে চিত্তে উৎপন্ন একটি তরঙ্গ “ভাবালযঙ্গ-বিধান' বলে, আর কার্য কারণ-সম্বন্ধ এই ব্যাপক বিধানের একটি
সর্বদাই অনেক সদৃশ তরঙ্গ উৎপন্ন করে। মনােবিজ্ঞানে ইহাকেই দিকমাত্র। ভাবানুষঙ্গের এই ব্যাপকতাকেই সংস্কৃতে ব্যাপ্তি বলে। অন্তর্জগতে যেমন, বহির্জগতেও তেমনি বিধান বা নিয়মের ধারণা একই প্রকার  একটি
ঘটনার পর আর একটি ঘটিবে তাহা এবং ঘটনাপরম্পরা বার বার দুটিতে থাকিবে, আমরা এইরূপই আশা করি। তাহা হইলে প্রকৃতপক্ষে কোন নিয়ম প্রকৃতিতে নাই। কার্যতঃ ইহা বলা ভুল যে, মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীতে আছে, অথবা প্রকৃতির কোন স্থলে বস্তুগতভাবে কোন নিয়ম আছে। যে প্রণালীতে
আমাদের মন কতকগুলি ঘটনাপরম্পরা ধারণা করে, সেই প্রণালীই নিয়ম  ; এই নিয়ম আমাদের মনে অবস্থিত। কতকগুলি ঘটনা একটির পর আর একটি
অথবা একসঙ্গে সংঘটিত হইলে আমাদের মনে দৃঢ় ধারণা হয়, ভবিষ্যতে নিয়মিতভাবে পুনঃপুনঃ এইরূপ ঘটিবে ; ঘটনাপরম্পরা কিভাবে সংঘটিত হইতেছে, আমাদের মন এইভাবেই তাহা ধরিতে পারে। ইহাকে বলা  হয় নিয়ম। এখন জিজ্ঞাস্য নিয়ম সর্বব্যাপক’ বলিতে আমরা কি বুঝি? আমাদের জগৎ অনন্ত সত্তার সেইটুকু অংশ, যাহাকে আমাদের দেশের
মনােবিজ্ঞানবিদগণ 'দেশ-কাল-নিমিত্ত' বলেন এবং ইউরােপীয় মনােবিজ্ঞানে যাহা স্থান কাল ও কারণ (time, causation) বলিয়া পরিচিত। এই জগৎ
সেই অনন্ত সত্তার এতটুকু অংশমাত্র, একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে ঢালা, দেশ-কাল-নিমিত্তে গঠিত। ঐরূপে ছাঁচে-ঢালা অস্তিত্ব-সমষ্টির নামই আমাদের জগৎ। অপরিহার্যভাবে এই সিদ্ধান্ত করিতে হয় যে, নিয়ম কেবল এই কার্য-কারণ-নিয়ন্ত্রিত জগতের মধ্যেই সম্ভব, ইহার বাহিরে কোন নিয়ম থাকিতে পারে না। যখন আমরা এই জগতের কথা বলি, তখন আমরা বুঝি,
অস্তিত্বের যে অংশটুকু আমাদের মনের দ্বারা সীমাবদ্ধ, যে ইন্দ্রিয়গােচর জগৎ আমরা অনুভব করি, স্পর্শ করি, দেখি, শুনি, চিন্তা করি এবং কল্পনা করি,
সেইটুকুই কেবল নিয়মাধীন; কিন্তু ইহার বাহিরের সত্তা নিয়মের অধীন নয়, যেহেতু কার্য-কারণ-ভাব আমাদের মনােজগতের বাহিরে আর যাইতে পারে
না। আমাদের ইন্দ্রিয়-মনের অতীত কোন বস্তুই এই কার্য-কারণ-নিয়ম দ্বারা বদ্ধ নয়, কারণ ইন্দ্রিয়াতীত রাজ্যে বিভিন্ন বস্তুর ভাবানুযঙ্গ-সম্বন্ধ নাই, এবং
ভাব-সম্বন্ধ ব্যতীত কার্যকারণ-সম্বন্ধও থাকিতে পারে না। নামরূপের ছাঁচের মধ্যে পড়িলেই সত্তা বা চৈতন্য কার্য-কারণ-নিয়ম মানিয়া চলেন এবং তখনই
বলা হয় উহা নিয়মের অধীন, যেহেতু কার্য-কারণ-সম্বন্ধই সকল নিয়মের মূল। এখন আমরা সহজেই বুঝিতে পারি যে, স্বাধীন ইচ্ছা বলিয়া কিছু
থাকিতে পারে না; ঐ শব্দগুলি পরস্পরবিরুদ্ধ, কারণ ইচ্ছা জ্ঞানের অন্তর্গত এবং যাহা কিছু আমরা জানি সে-সবই আমাদের জগতের অন্তর্গত। আবার
জগতের অন্তর্গত সবকিছুই দেশকাল-নিমিত্তের উঁচে ঢালা। যাহা কিছু আমরা জানি বা যাহা কিছু জানা আমাদের পক্ষে সম্ভব, সবই কার্য-কারণের অধীন ;
না। অন্যান্য বস্তু ইহার উপর ক্রিয়া করে এবং ইহাও আবার অপরের কারণ। এবং যাহা কিছু কার্যকারণ-নিয়মের অধীন, তাহা কখনাে স্বাধীন হইতে পারে।
হয়, এইরূপে চলিতেছে। যাহা পর্বে 'ইচ্ছা' ছিল না, কিন্তু ইচ্ছারূপে পরিণত হয়, যাহা এই দেশ-কাল-নিমিত্তের ছাচে পড়িয়া মানুষের ইচ্ছারূপে পরিণত
হইয়া যাইবে, তখন আবার স্বাধীন বা মুক্ত হইবে। স্বাধীনতা বা মুক্তি হইতেই হইয়াছে, তাহা মুক্তস্বভাব; আর যখন এই ইচ্ছা কার্য-কারণ-চক্র' হইতে বাহির
উহা আসে, এই বন্ধনের ছাঁচে পড়ে এবং বাহির হইয়া আবার মুক্ত হয় । প্রশ্ন উঠিয়াছিল, জগৎ কোথা হইতে আসে, কোথায় অবস্থান করে এবং
কিসেই বা লীন হয়? উত্তরও প্রদত্ত হইয়াছে মুক্তি হইতেই ইহার উৎপত্তি , বন্ধনে ইহার স্থিতি এবং অবশেষে মুক্তিতেই প্রত্যাবর্তন। সুতরাং যখন আমরা
বলি, মানুষ সেই অনন্ত সত্তার প্রকাশ, তখন বুঝিতে হইবে সেই সত্তার অতি ক্ষুদ্র অংশ মানুষ। এই দেহ ও এই মন যাহা আমরা দেখিতেছি, এগুলি
সমগ্রের অংশমাত্র, সেই অনন্ত পুরুষের একটি বিন্দুমাত্র। সমুদয় ব্রহ্মাণ্ডই সেই অনন্ত পুরুষের একটি কণামাত্র। আর আমাদের সকল নিয়ম ও বন্ধন,
আনন্দ ও বিষাদ, আমাদের সুখ ও আশা সবই এই ক্ষুদ্র জগতের ভিতরে। আমাদের উন্নতি ও অবনতি সবই এই ক্ষুদ্র জগতে সীমাবদ্ধ। অতএব দেখিতেছ, আমাদের মনের সৃষ্টি এই ক্ষুদ্র জগহ চিরকাল থাকিবে এরূপ
আশা করা এবং স্বর্গে যাইবার আকাক্ষা করা কি ছেলেমানুষি! স্বর্গের অর্থ আমাদের পরিচিত এই জগতের পুনরাবৃত্তিমাত্র। স্পষ্টই দেখিতেছ,
অনন্ত সত্তাকে আমাদের সীমাবদ্ধ জগতের অনুরূপ করিতে চেষ্টা করা কি ছেলেমানুষি ও অসম্ভব বাসনা! অতএব যখন মানুষ বলে, সে এইভাবেই চিরদিন থাকিবে, এখন যাহা লইয়া আছে, তাহা লইয়াই চিরদিন থাকিবে , অথবা আমি যেমন কখনাে কখনাে বলি, যখন মানুষ ‘আরামের ধর্ম' চায়, তখন তােমরা নিশ্চয় জানিও তাহার এত অবনতি হইয়াছে যে, সে বর্তমান
অবস্থা অপেক্ষা উন্নততর কিছুই ধারণা করিতে পারে না; সে নিজের অনন্ত স্বরূপ ভুলিয়াছে; তাহার সমগ্র চিন্তা এই সব ক্ষুদ্র সুখ-দুঃখ এবং সাময়িক
ঈর্ষায় আবদ্ধ। এই সাপ্ত জগৎকেই সে 'অনন্ত বলিয়া মনে করে। শুধু তাই নয়, সে এই মূখত কোনমতে ছাড়িবে না। সে প্রাণপণে 'তৃষ্ণা'কে জীবন-বাসনাকে আকড়াইয়া থাকে। বৌদ্ধেরা ইহাকে 'তহা বা তিস্সা
অংশমাত্র। বলে। আমাদের জ্ঞাত ক্ষুদ্র জগতের বাহিরে অসংখ্য প্রকার সুখ-দুঃখ, অসংখ্য প্রাণী, অসংখ্য বিধি, অসংখ্য প্রকার উন্নতি এবং অসংখ্য প্রকার।
কার্য-কারণ-সম্বন্ধ থাকিতে পারে কিন্তু এ সবই আমাদের অনন্ত প্রকৃতির এক হইবে; এখানে মুক্তির সন্ধান পাওয়া যাইতে পারে না। সম্পূর্ণ সাম্যাবস্থা
মুক্তি লাভ করিতে হইলে এই জগতের সীমা অতিক্রম করিয়া যাইতে খ্রীস্টানরা যাহাকে ‘বুদ্ধির অতীত শান্তি বলিয়া থাকেন, তাহা এই জগতে
পাওয়া যাইতে পারে না স্বর্গেও নয়, অথবা এমন কোন স্থানেও নয় , যেখানে আমাদের চিন্তাশক্তি ও মন যাইতে পারে, যেখানে ইন্দ্রিয়গণ অনুভব করিতে পারে, অথবা কল্পনা শক্তি যাহা কল্পনা করিতে পারে এরূপ কোন
স্থানেই সেই মুক্তি পাওয়া যাইতে পারে না, কারণ এ সকল স্থান অবশ্যই আমাদের জগতের অন্তর্গত হইবে এবং সেই জগৎ দেশ-কাল-নিমিত্ত দ্বারা সীমাবদ্ধ। এই পৃথিবী অপেক্ষা সূক্ষ্মতর স্থান থাকিতে পারে যেখানে ভােগতী ব্রতর, কিন্তু সে-সকল স্থানও জগতের অন্তর্গত, সুতরাং নিয়মের বন্ধনের ভিতর; অতএব আমাদিগকে এ-সকলের বাহিরে যাইতে হইবে এবং যেখানে
এই ক্ষুদ্র জগতের শেষ, সেখানেই প্রকৃত ধর্মের আরম্ভ। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দ, বিষাদ ও বস্তু-বিষয়ক জ্ঞান সবই সেখানে শেষ হইয়া যায় এবং প্রকৃত সত্য আরম্ভ হয়। যতদিন না আমরা জীবনের না এই তৃষ্ণা বিসর্জন
দিতে পারি, যতদিন না এই ক্ষণস্থায়ী সত্তার প্রতি প্রবল আসক্তি ত্যাগ করিতে পারি, ততদিন জগতের অতীত সেই অনন্ত মুক্তির এতটুকু আভাসও
পাইবার আশা আমাদের নাই। অতএব ইহা যুক্তিসঙ্গত যে, মনুষ্য জাতির উচ্চাকাঙ্ক্ষার চরম লক্ষ্য মুক্তি লাভ করিবার একটিমাত্র উপায় আছে, সে
উপায় এই ক্ষুদ্র জীবন, এই নূত্র জগৎ, এই পৃথিবী, এই স্বর্ণ, এই শরীর এবং যাহা কিছু সীমাবদ্ধ সব ত্যাগ করা। যদি আমরা ইন্দ্রিয় ও মনের দ্বারা
সীমাবদ্ধ এই ক্ষুদ্র জাহ ত্যাগ করিতে পারি, তবে আমরা এখনই মুক্ত হইব। বন্ধন হইতে মুক্ত হওয়ার একমাত্র উপায়—সমুদয় নিয়মের বাহিরে যাওয়া,
কার্যকারণ-শঙ্খলের বাহিরে যাওয়া; আর যেখানেই এই জগই আছে , সেখানেই কার্য-কারণ-শৃঙ্খল বর্তমান।
কিন্তু এই জগতের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করা বড় কঠিন ব্যাপার। অতি অল্প লােকই এই আসক্তি ত্যাগ করিতে পারে। আমাদের শাস্ত্রে আসক্তি-ত্যাগের দুইটি উপায় কথিত হইয়াছে। একটিকে বলে নিবৃত্তিমার্গ
উহাতে নেতি নেতি' (ইহা নয়, ইহা নয়) করিয়া সব ত্যাগ করিতে হয়,  আর একটিকে বলে প্রবৃত্তিমার্গ উহাতে ‘ইতি ইতি’ করিয়া সকল বস্তু গ্রহণ
করিয়া তাহার পর ত্যাগ করা হয়। নিবৃত্তিমার্গ অতি কঠিন। উহা কেবল উন্নতমনা অসাধারণ প্রবল ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষদের পক্ষেই সম্ভব।
তাহাৱা শুধু বলেন, “না, আমি ইহা চাই না; শরীর ও মন তাহাদের আজ্ঞা পালন করে, এবং তাহারা সাফল্যমণ্ডিত হন। কিন্তু এরূপ মানুষ অতি বিরল।
অধিকাংশ লােক তাই প্রবৃত্তিমার্গ সংসারেরই পথ বাছিয়া লয় ; এবং বন্ধনগুলিকেই বন্ধন ভাঙিবার উপায়রূপে ব্যবহার করে। ইহাও একপ্রকার
ত্যাগ, তবে ধীরে ধীরে ক্রমশঃ ত্যাগ করা হয়। সমস্ত পদার্থকে জানিয়া, ভােগ করিয়া, এইরূপে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়া, সংসারের সকল বস্তুর প্রকৃতি
অবগত হইয়া মন অবশেষে ঐগুলি ছাড়িয়া দেয় এবং অনাসক্ত হয়। অনাসক্তিলাভের প্রথমােক্ত মার্গের সাধন বিচার, আর শেষােক্ত পথের সাধনকর্ম ও অভিজ্ঞতা। প্রথমটি জ্ঞানযােগের পথ, কোন প্রকার কম
করিতে অস্বীকার করাই এ পথের বৈশিষ্ট্য। দ্বিতীয়টি কর্মযােগের পথ, এ পথে কর্মের বিরতি নাই। এই জগতে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই কর্ম করিতে হইবে।
কেবল যাহারা সম্পূর্ণরূপে আত্মতৃপ্ত, যাহারা আত্মা বাতীত আর কিছুই চান না, যাহাদের মন কখনাে আত্মা হইতে অন্যত্র গমন করে না, আত্মাই যাহাদের
সর্বগ, শুধু তাহারাই কর্ম করিবেন না। অবশিষ্ট সকলকে অবশ্যই কর্ম করিতে হইবে।
একটি জলস্রোত স্বচ্ছন্দগতিতে নামিতেছে। একটি গর্তের ভিতর পড়িয়া ঘূর্ণিরূপে পরিণত হইল; সেখানে কিছুকাল ঘুরিবার পর উহা আবার সেই
উন্মুক্ত স্রোতের আকারে বাহির হইয়া দুর্বার বেগে প্রবাহিত হয়। প্রত্যেক মনুষ্য-জীবন এই প্রবাহের মতাে। উহাও ঘূর্ণির মধ্যে পড়েনাম-রূপাত্মক
জগতের ভিতর পড়িয়া হাবুডুবু খায়, কিছুক্ষণ 'আমার পিতা, আমার মাতা, আমার নাম, আমার যশ’ প্রভৃতি বলিয়া চিৎকার করে, অবশেষে বাহির হইয়া
নিজের মুক্ত ভাব ফিরিয়া পায়। সমুদয় জাং ইহাই ঝরিতেছে, আমরা জানি বা নাই জানি, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে আমরা সকলেই জারূপ স্বপ্ন
হইতে বাহির হইবার জন্য কাজ করিতেছি। সংসার-আবর্ত হইতে মুক্ত হওয়ার জন্যই মানুষের এই সাংসারিক অভিজ্ঞতা। কর্মযােগ কি ?কম-রহস্য অবগত হওয়াই কর্মযােগ। আমরা দেখিতেছি।
সমুদয় জগৎ কর্ম করিতেছে। কিসের জন্য মুক্তির জন্য, স্বাধীনতা লাভের জন্য। পরমাণু হইতে মহােচ্চ প্রাণী পর্যন্ত সকলেই জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে
সেই এক উদ্দেশ্যে কর্ম করিয়া চলিয়াছে, সেই উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য মনের স্বাধীনতা, দেহের স্বাধীনতা, আত্মার স্বাধীনতা। সকল বস্তুই সর্বদা মুক্তিলাভ
করিতে এবং বন্ধন হইতে ছুটিয়া পলাইতে চেষ্টা করিতেছে। সূর্য চন্দ্র পৃথিবী। গ্রহ সকলেই বন্ধন হইতে পলায়ন করিতে চেষ্টা করিতেছে। সমগ্র
জগৎটাকে এই কেন্দ্রানুগা ও কেন্দ্রাতিগ শক্তিদ্বয়ের ক্রীড়াভূমি বলা যাইতে পারে। কর্মযােগ আমাদিগকে কর্মের রহস্য-কর্মের প্রণালী শিখাইয়া দেয়।
জগতের চতুর্দিকে ধাকার পর ধাক্কা খাইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে অনেক বিচার বিবেকের পর শেখার পরিবর্তে আমরা কর্মযােগ হইতে কর্মের রহস্য, কর্মের
প্রণালী এবং কর্মের সংগঠনশক্তি সম্বন্ধে সরাসরি শিক্ষা লাভ করিয়া থাকি । ব্যবহার করিতে না জানিলে আমাদের বিপুল শক্তি বৃথা নষ্ট হইতে পারে।
কর্মযােগ কাজ করাকে একটি রীতিমত বিজ্ঞানে পরিণত করিয়াছে। এই বিদ্যা দ্বারা জানিতে পারিবে, এই জগতের সকল কর্মের সদ্ব্যবহার কিভাবে করিতে
হয়। কর্ম করিতেই হইবে, ইহা অপরিহার্য কিন্তু উচ্চতম উদ্দেশ্যে কর্ম কর । কর্মযােগের সাধনায় আমরা স্বীকার করিতে বাধা যে, এই জগৎ পাচ মিনিটের
জন্য, এবং ইহার মধ্য দিয়াই আমাদের চলিতে হইবে; আরও স্বীকার করিতে হয় যে, এখানে মুক্তি নাই, মুক্তি পাইতে হইলে আমাদিগকে জগতের বাহিরে
যাইতে হইবে। জগতের বন্ধনের বাহিরে যাইবার এই পথ পাইতে হইলে আমাদিগকে ধীরে নিশ্চিতভাবে ইহার মধ্য দিয়াই যাইতে হইবে। এমন সব অসাধারণ মহাপুরুষ থাকিতে পারেন, যাহাদের বিষয় আমি এইমাত্র বলিলাম, তাহাৱা একেবারে জগতের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইয়া উহাকে ত্যাগ করিতে
পারেন যেমন সর্প উহার ত্বক পরিত্যাগ করিয়া বাহির হইতে দেখিয়া থাকে। এই-সব অসাধারণ মানুষ কয়েকজন আছেন সন্দেহ নাই, কিন্তু অবশিষ্ট
মানবগণকে ধীরে ধীরে কর্মময় জগতের ভিতর দিয়াই যাইতে হইবে। অল্পশক্তি নিয়ােগ করিয়া অধিক ফল লাভ করিবার প্রণালী, রহস্য ও উপায় দেখাইয়া দেয় কর্মযােগ
কর্ম বা কার্য দ্বারা মুক্তি: Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History
Swami  Vivekananda
কর্মযােগ কি বলে?  বলে, 'নিরন্তর কর্ম কর, কিন্তু কর্মে আসক্তি 'ত্যাগ কর।' কোন কিছুর সহিত নিজেকে জড়াইও না। মনকে মুক্ত রাখ। যাহা কিছু
দেখিতেছ, দুঃখ-কষ্ট—সবই জগতের অপরিহার্য পরিবেশ মাত্র দারিদ্র্য, ধনা ও সুখ শণস্থায়ী, উহারা মােটেই আমাদের স্বভাবগত নয়। আমাদের স্বরূপ দুঃখ
ও সুখের পারে প্রত্যক্ষ বা কল্পনার অতীত ; 'তথাপি আমাদিগকে সর্বদাই কর্ম করিয়া যাইতে হইবে। “আসক্তি হইতেই দুঃখ আসে, কর্ম হইতে নয়।"
যখনই আমরা কর্মের সহিত নিজেদের অভিন্ন করিয়া ফেলি, তখনই আমরা দূঃখ বােধ করি, কিন্তু কর্মের সহিত ঐরূপ এক না হইয়া গেলে সেই
দুঃখ অনুভব করি না। কাহারও একখানি সুন্দর ছবি পুড়িয়া গেলে সাধারণতঃ অপর একজনের কোন দুঃখ হয় না, কিন্তু যখন তাহার নিজের ছবিখানি
পুড়িয়া যায়, তখন সে কত দুঃখ বােধ করে। কেন? দুইখানিই সুন্দর ছবি , হয়তাে একই মূলছবির নকল, কিন্তু একক্ষেত্র অপেক্ষা অন্যক্ষেত্রে অতি দারুণ
দুঃখ অনুভূত হয়। ইহার কারণ—এক্ষেত্রে মানুষ ছবির সহিত নিজেকে অভিন্ন করিয়া ফেলিয়াছে, অপর ক্ষেত্রে তাহা করে নাই। এই “আমি ও আমার ভাবহ সকল দুঃখের কারণ। অধিকারের ভাব হইতেই স্বার্থ আসে এবং আরম্ভ। প্রতিটি স্বার্থপর কার্য বা চিন্তা আমাদিগকে কোন-না-কোন বিষয়ে আসক্ত করে, এবং আমরা সঙ্গে সঙ্গে সেই বস্তুর দাস হইয়া যাই। চিত্তের যে-কোন তরঙ্গ হইতে 'আমি ও আমার ভাব উথিত হয়,
তাহা তৎক্ষণাৎ আমাদিগকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া ক্রীতদাসে পরিণত করে, যতই আমরা ‘আমি ও আমার বলি, ততই দাসত্ব বাড়িতে থাকে, ততই দুঃখও
বাড়িতে থাকে। অতএব কর্মযােগ বলে জগতে যত ছবি আছে, সবগুলির সৌন্দর্য উপভােগ কর, কিন্তু কোনটির সহিত নিজেকে এক করিয়া ফেলিও
না; আমার কখনাে বলিও না। আমরা যখনই বলি, “এটি আমার', তখনই সঙ্গে সঙ্গে দুঃখ আসিবে। 'আমার সন্তান একথা মনে মনে বলিও না ।
ছেলেকে আদর কর, তাহাকে নিজ আয়ত্তে রাখ, কিন্তু আমার বলিও না ।আমার' বলিলেই দুঃস্থ আসিবে। আমার বাড়ি', 'আমার শরীর এরূপও
কাহারও নয়। এগুলি প্রকৃতির নিয়মে আসিতেছে, যাইতেছে, কিন্তু আমরা বলিও না। এইখানেই মুশকিল। এই শরীর তােমারও নয়, আমারও নয়,
শরীরের তলপেক্ষা বেশি নই। একটা শরীরের প্রতি আমরা এত আসক্ত হইব মুক্ত সাক্ষিস্বরূপ। একখানি ছবি বা দেওয়ালের যতটুকু স্বাধীনতা আছে,
কেন যনি কেহ একখানি ছবি আঁকে, সেটি শেষ করিয়া অন্যটিতে হাত দেয়। আমি উহা অধিকার করিব'বলিয়া স্বার্থজাল বিস্তার করিও না । যখনই এই স্বার্থর্জিাল বিস্কৃত হয়, তখনই দুঃখের আর। অতএব কর্মযােগে বলা হয়। প্রথমে এই স্বার্থপরতার জাল বিস্তার
করিবার প্রবণতা বিনষ্ট কর, যখন উহা দমন করিবার শক্তি লাভ করিবে, এখন মনকে আর স্বার্থপরতা তরঙ্গে পরিণত হইতে দিও না। তারপর সংসারে
গিয়া যত পার কর্ম বির, সর্বত্র গিয়া মেলামেশা কর, যেখানে ইচ্ছা যাও , মন্দের ছায়া তোমাকে যখনই দূষিত করিতে পারিবে না। ধাপর জলের হিয়াছে, জল যেমন কখনাে উহাতে লিপ্ত হয় না, তুমিও সেইভাবে সংসারে
থাকিবে; ইহাই ‘বৈরাগ্য বা অনাসক্তি। মনে হয়, তােমাদিগকে বলিয়াছি যে, অনাসক্তি ব্যতীত কোন প্রকার ‘যােগই হইতে পারে না। অনাসক্তি সকল
যােগেরই ভিত্তি। যে ব্যক্তি গৃহে বাস, উত্তম বস্ত্র পরিধান এবং সুখাদ্য ভােজন পরিত্যাগ করিয়া মরুভূমিতে গিয়া থাকে, সে অতিশয় আসক্ত হইতে পারে ; তাহার একমাত্র সম্বল নিজের শরীর তাহার নিকট সর্বস্ব হইতে পারে ,  ক্রমশঃ তাহাকে তাহার দেহের জন্যই প্রাণপণ সংগ্রাম করিতে হইবে । অনাসক্তি বাহিরের শরীরকে লইয়া নয়, অনাসক্তি মনে। আমি ও
আমার' এই বন্ধনের শৃঙ্খল মনেই রহিয়াছে। যদি শরীরের সহিত এবং ইন্দ্রিয়ভােগ্য বিষয়সমূহের সহিত এই যােগ না থাকে, তবে আমরা যেখানেই
থাকি না কেন, যাহাই হই না কেন, আমরা অনাসক্ত। একন-সিংহাসনে উপবিষ্ট হইয়াও সম্পূর্ণ অনাসক্ত হইতে পারে, আর একজন হয়তাে
ছিঃবস্তু-পরিহিত হইয়াই ভয়ানক আসক্ত। প্রথমে আমাদিগকে এই অনাসক্ত অবস্থা লাভ করিতে হইবে, তারপর নিরন্তর কার্য করিতে হইবে। যে কর্ম
প্ৰণালী আমাদিগকে সর্বপ্রকার আসক্তি ত্যাগ করিতে সাহায্য করে ,কর্মযােগ আমাদিগকে তাহাই দেখাইয়া দেয়। অবশ্য ইহা অতি কঠিন। সকল আসক্তি ত্যাগ করিবার দুটি উপায় আছে। একটি যাহারা ঈশ্বরে
অথবা বাহিরের কোন সহায়তায় বিশ্বাস করে না, তাহাদের জন্য। তাহারা নিজেদের কৌশল বা উপায় অবলম্বন করে। তাহাদিগকে নিজেরেই
ইচ্ছাশক্তি, মনঃশক্তি ও বিচার অবলম্বন করিয়া কম করিতে হইবে তাহাদিগকে জোর করিয়া বলিতে হইবে, 'আমি নিশ্চয় অনাসক্ত হইণ। অনাটিহারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, তাহাদের পক্ষে ইহা করিয়া যান, সুতরাং কর্মফলে আসক্ত হন না। তাহারা যাহা কিছু দেখেন,
অপেক্ষাকৃত সহজ। তাহারা কর্মের সমুদয় ফল ভগবানে অপণ করিয়া কাজ অনুভব করেন, শােনেন করেন, সবই ভগবানের জন্য। আমরা যে কোন
ভাল কাজ করি না কেন, তাহার জন্য যেন আমরা মােটেই কোন প্রশংসা বা সুবিধা দাবি না করি। উহা প্রভুর, সুতরাং কর্মের ফল তাহাকেই অর্পণ কর।
আমাদিগকে একধারে সরিয়া দাড়াইয়া ভাবিতে হইবে, আমরা প্রভুর আবহ ২তমাত্র, এবং আমাদের প্রত্যেক কর্ম-প্রবৃত্তি প্রতি মুহূর্তে তাহা হইতেই আসিতেছে
যং করােষি যদাসি যজ্জহােষি দদাসি যং।
যত্তপসসি কৌন্তেয় তৎ কুরুধ মদৰ্পণম্ ॥১
যাহা কিছু কাজ কর, যাহা কিছু ভােগ কর, যাহা কিছু পূজা হােম কর, যাহা কিছু দান কর, যাহা কিছু তপস্যা কর, সবই আমাতে অর্থাৎ ভগবানে অৰ্পণ করিয়া শান্তভাবে অবস্থান কর।” আমরা নিজেরা যেন সম্পূর্ণ শান্তভাবে থাকি এবং আমাদের শরীর মন ও সব-কিছু ভগবানের উদ্দেশ্যে চিরদিনের জন্য বলি প্রদত্ত হয়। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিয়া যজ্ঞ করিবার পরিবর্তে অহােরাত্র
এই ক্ষুদ্র ‘অহং'কে আহুতি দানরাপ মহাযজ্ঞ কর।
‘জগতে ধন অন্বেষণ করিতে গিয়া একমাত্র ধনস্বরূপ তোমাকেই পাইয়াছি ,তােমারই চরণে নিজেকে সমর্পণ করিলাম। জগতে একজন প্রেমাস্পদ
খুঁজিতে গিয়া একমাত্র প্রেমাস্পদ তােমাকেই পাইয়াছি, তােমাতেই আত্মসমর্পণ করিলাম।' দিবারাত্র আবৃত্তি করিতে হইবেঃ 'আমার জন্য কিছুই
নয়; কোন বস্তু শুভ, অশুভ বা নিরপেক্ষ—যাহাই হউক না কেন, আমার পক্ষে সবই সমান ; আমি কিছুই গ্রাহ্য করি না, 'আমি সবই তােমার চরণে সমৰ্পণ করিলাম।
দিবারাত্র এই আপাত-প্রতীয়মান 'অহং'ভাব ত্যাগ করিতে হইবে, যে পর্যন্ত না ঐ ত্যাগ একটি অভ্যাসে পরিণত হয়, যে পর্যন্ত না উহা শিরায় শিরায়,
মজ্জায় ও মস্তিষ্কে প্রবেশ করে এবং সমগ্র শরীরটি প্রতি মুহুর্তে ঐ আত্মত্যাগরূপ ভাবের অনুগত হইয়া যায়। মনের এরূপ অবস্থায় কামানের
গর্জন ও কোলাহলপূর্ণ রণক্ষেত্রে গমন করিলেও অনুভব করিবে, তুমি মুক্ত ও কর্মযােগ আমাদিগকে শিক্ষা দেয় কর্তব্যের সাধারণ ভাব কেবল নিম্ন
ভূমিতেই বর্তমান ; তথাপি আমাদের প্রত্যেককেই কৰ্তব্য কর্ম করিতে হইবে। কিন্তু আমরা দেখিতেছি, এই অদ্ভুত কর্তব্যবােধ অনেক সময় আমাদের দুঃখের একটি বড় কারণ। কর্তবা আমাদের পক্ষে রােগ-বিশেষ হইয়া পড়ে
এবং আমাদিগকে সর্বদা টানিয়া লইয়া যায়। কর্তব্য আমাদিগকে ধরিয়া রাখে এবং আমাদের সমগ্র জীবনটাই দুঃখপূর্ণ করিয়া তুলে। ইহা মনুষ্য-জীবনের
ধ্বংসের কারণ।

দ্বিতীয় পর্ব টি পড়ুন এখানে ক্লিক করে


...........................Life History....................... 

1 comment:

  1. I don't understand Bengali Language..but only I love Swami Vivekanandji, I've translate Text in Hindi n read it. love this..Thank you..

    Pls read my Blog too..I have also writing Motivational stories. Blog is in Marathi Language.but u can translate it in ur language.

    www.ojaslekh.in

    ReplyDelete

Powered by Blogger.