পরােপকারে নিজেরই উপকার :Swami Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History

পরােপকারে নিজেরই উপকার :Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History 
পরােপকারে নিজেরই উপকার :Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History
কর্তব্যনিষ্ঠা দ্বারা আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির কিরূপ সহায়তা হয়, সে বিষয়ে আরও অধিক আলােচনা করিবার পূর্বে ‘কর্ম' বলিতে ভারতে আমরা যাহা বুঝিয়া থাকি, তাহার আর একটি দিক যত সংক্ষেপে সম্ভব
তােমাদের নিকট বিবৃত করিতে চেষ্টা করিব। প্রত্যেক ধর্মেই তিনটি করিয়া ভাগ আছে, যথা দার্শনিক, পৌরাণিক ও আনুষ্ঠানিক। অবশ্য দার্শনিক ভাগই
প্রত্যেক ধর্মের সার। পৌরাণিক ভাগ ঐ দার্শনিক ভাগেরই বিবৃতিমাত্র,  উহাতে মহাপুরুষগণের অল্পবিস্তর কাল্পনিক জীবনী এবং অলৌকিক
বিষয়সংক্রান্ত উপাখ্যান ও গল্পসমূহ দ্বারা ঐ দর্শনকেই উত্তমরূপে বিবৃত করিবার চেষ্টা করা হইয়াছে। আর আনুষ্ঠানিক ভাগ ঐ দর্শনেরই আরও সুলতর রূপ যাহাতে সকলেই উহা ধারণা করিতে পারে; প্রকৃতপক্ষে
অনুষ্ঠান দর্শনেরই স্থূলতর রূপ। এই অনুষ্ঠানই কর্ম। প্রত্যেক ধর্মেই ইহা প্রয়ােজনীয়, কারণ আমাদের মধ্যে অনেকেই—যতদিন না আধ্যাত্মিক বিষয়ে
যথেষ্ট উন্নতি লাভ করিতেছে, ততদিন সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক তত্ত্ব ধারণা করিতে অসমর্থ। লােকে সহজেই ভাবিয়া থাকে, তাহারা সকল বিষয়ই বুঝিতে পারে ;
কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় সুক্ষ্ম ভাবসমূহ হৃদয়ঙ্গম করা বড়ই কঠিন। এই কারণে প্রতীকের দ্বারা বিশেষ সাহায্য হইয়া থাকে, আর প্রতীকের সাহায্যে
কোন বস্তুকে ধারণা করিবার প্রণালী আমরা কিছুতেই ত্যাগ করিতে পারি না। স্মরণাতীত কাল হইতে সকল ধর্মেই প্রতীকের ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায়। এক হিসাবে আমরা প্রতীক ব্যতীত চিন্তাই করিতে পারি না; শব্দ সমূহতাে চিন্তারই প্রতীক। অন্য হিসাবে জগতের সমুদয় পদার্থকেই প্রতীক রূপেদেখা যাইতে পারে। সমগ্র জগৎ একটি প্রতীক, আর ইহার পশ্চাতে মূলতত্ত্ব
ঈশ্বর। এই প্রতীকঙ্কান পুরাপুরিভাবে মানব-সৃষ্ট নয়। কোন বিশেষ ধর্মাবলম্বী কয়েকজন ব্যক্তি একস্থানে বসিয়া ভাবিয়া চিন্তিয়া স্বকপােলকল্পিত কতকগুলি
প্রতীকের সৃষ্টি করিলেন এরূপ নয়। প্রতীকগুলি স্বভাবতঃ উৎপন্ন হইয়া থাকে। তাহা না হইলে কতকগুলি প্রতীক প্রায় প্রত্যেক ব্যক্তির মনেই
কতকগুলি বিশেষ ভাবের সহিত জড়িত কেন? কতকগুলি প্রতীক সর্বজনীনভাবে প্রচলিত। তােমাদের অনেকের ধারণা খ্রীস্টধর্মের সংস্পর্শেই।
ক্রশ-চিহ্ন প্রথম আবির্ভূত হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে খ্রীস্টধর্মের বহু পূর্ব হইতে , মুশা জন্মিবার পূর্ব হইতেই, বেদের আবির্ভাব হইবার পূর্ব হইতে এমন কি
মানুষের কার্যকলাপের কোনপ্রকার মানবীয় ইতিহাস রক্ষিত হইবার পূর্ব হইতেই উহা বর্তমান ছিল। আজটেক ও ফিনিসীয় জাতির মধ্যেও কুশ-প্রতীক প্রচলিত ছিল, তাহার প্রমাণ পাওয়া যাইতে পারে। খুব সম্ভব,
সকল জাতিই এই ক্রুশ-চিহ্ন ব্যবহার করিত।
আর ক্রুশবিদ্ধ পরিত্রাতার—ক্রুশবিদ্ধ হইয়া রহিয়াছে এরূপ একটি মানুষের প্রতীক প্রায় সকল জাতির মধ্যে ছিল বলিয়া বােধ হয়। সমগ্র জগতের মধ্যে বৃত্ত একটি উৎকৃষ্ট প্রতীকের স্থান অধিকার করিয়াছে। তাহার
পর সর্বাপেক্ষা সর্বজনীন প্রতীক ‘স্বস্তিক’ রহিয়াছে। একসময়ে লােকে ভাবিত, বৌদ্ধগণ সমগ্র জগতে উহা ছড়াইয়া দিয়াছে, কিন্তু এখন জানা গিয়াছে যে, বৌদ্ধধর্মের অভুদয়ের অনেক পূর্ব হইতেই বিভিন্ন জাতির মধ্যে উহা প্রচলিত ছিল। প্রাচীন বাবিলন ও মিশরে ইহা দেখা যাইত। ইহা দ্বারা কি প্রমাণ হইতেছে ?এই প্রতীকগুলি শুধু রীতিগত বা কল্পনাপ্রসূত নয়।
নিশ্চয়ই উহাদের কোন যুক্তি আছে, মনুষ্য-মনের সহিত উহাদের কোনরূপ স্বাভাবিক সম্বন্ধ আছে। ভাষাও একটা কৃত্রিম বস্তু নয়। কয়েকজন লােক
একত্র হইয়া কতকগুলি ভাবকে বিশেষ বিশেষ শব্দ দ্বারা প্রকাশ করিবে এইরূপ সন্মত হওয়াতে ভাষার উৎপত্তি হইয়াছে ইহা সত্য নয় । কোন ভাই তাহার অনুরূপ শব্দ ব্যতিরেকে অথবা কোন শব্দই তাহার
অনুরূপ ভাৰ ব্যতিরেকে থাকিতে পারে না। শব্দ ও ভাব স্বভাবতই অবিচ্ছেদ্য। ভাবসমূহ বুঝাইবার জন্য শব্দ বা বর্ণ-প্রতীক উভয়ই ব্যবহৃত হইতে পারে। বধির ও মূক ব্যক্তিদিগকে শব্দ-প্রতীক ছাড়া অন্য প্রতীকের সাহায্যে চিন্তা করিতে হয়। মনের প্রত্যেকটি চিন্তার পরিপূরক হিসাবে একটি করিয়া রূপ আছে। সংস্কৃত দর্শনে উহাদিগকে ‘নাম-রূপ' বলা হয়।
যে মন কৃত্রিম উপায়ে ভাষা সৃষ্টি করা অসম্ভব, সেরূপ কৃত্রিম উপায়ে প্রতীক সৃষ্টি করাও অসম্ভব। পৃথিবীতে প্রচলিত আনুষ্ঠানিক ধর্মের প্রতীকগুলির মধ্যে মানবজাতির ধর্মচিন্তার অভিব্যক্তি দেখিতে পাই। অনুষ্ঠান, মন্দির ও অন্যান্য বাহ্য আড়ম্বরের কোন প্রয়ােজন নাই—একথা বলা খুব সহজ। আজকাল ছােট শিশুও এ-কথা বলিয়া থাকে। কিন্তু ইহাও অতি সহজেই দেখা যায় যাহারা মন্দিরে গিয়া উপাসনা করে না, তাহাদের চেয়ে যাহারা মন্দিরে উপাসনা করে, তাহারা অনেক বিষয়ে অন্যরূপ। এই কারণে কোন কোন ধর্মের সহিত যে-সব বিশেষ প্রকার মন্দির, অনুষ্ঠান ও অন্যান্য স্কুল ক্রিয়াকলাপ জড়িত আছে, তাহা সেই সেই ধর্মাবলম্বীর মনে—ঐ স্কুল বস্তুগুলি যে-সব ভাবের প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হয়, সেই-সব ভাবের উদ্রেক করিয়া দেয়। আর অনুষ্ঠান ও প্রতীক একেবারে উড়াইয়া দেওয়া বিজ্ঞজনােচিত কাজ নয়। এইসকল বিষয়ের চর্চা ও অভ্যাস স্বভাবতই কর্মযােগের একটি অংশ।
এই কর্ম-বিজ্ঞানের আরও অনেক দিক আছে। তাহাদের মধ্যে একটি এই ভাব' ও 'শব্দের মধ্যে যে সম্বন্ধ আছে এবং শব্দশক্তি দ্বারা কি সাধিত হইতে পারে, তাহা জানা। সকল ধর্মে শব্দশক্তি স্বীকৃত হইয়াছে, এমন কি
কোন কোন ধর্মে সমগ্র সৃষ্টিই ‘শব্দ’ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে বলা হয়। ঈশ্বরের সঙ্কল্পের বাহাভাৰ শব্দ; আর যেহেতু ঈশ্বর সৃষ্টির পূর্বে সঙ্কল্প ও ইচ্ছা করিয়াছিলেন, সেইহেতু ‘শব্দ হইতেই সৃষ্টি হইয়াছে। এই জড়বাদী ইহসর্বস্ব জীবনের পেষণে ও ক্ষিপ্রতায় আমাদের স্নায়ুগুলি অচেতন ও কঠিন হইয়া পড়িতেছে। যতই আমরা বৃদ্ধ হই, যতই আমরা এই জগতে ঘা খাইতে থাকি , ততই আমরা অনুভূতিহীন হইয়া পড়ি; আর সে-সকল ঘটনা বারংবার আমাদের চতুর্দিকে ঘটিতেছে এবং আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার চেষ্টা
করিতেছে, সেগুলিকেও আমরা অবহেলা করিতে প্রবৃত্ত হই। যাহা হউক , সময়ে সময়ে মানবের নিজস্ব প্রকৃতি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং আমরা এইসকল সাধারণ ঘটনার অনেকগুলি দেখিয়া বিস্মিত হই ও সেগুলির
তত্ত্বানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই। আর এইরূপ বিস্ময়ই জানালােক-প্রাপ্তির প্রথম সােপান। শব্দের উচ্চ দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক মূল্য ছাড়িয়া দিলেও আমরা
দেখিতে পাই, শব্দপ্রতীক মানবের জীবন রঙ্গমঞ্চে এক প্রধান অংশ অভিনয় করিয়া থাকে। আমি তােমার সহিত কথা কহিতেছি, আমি তােমাকে স্পর্শ
করিতেছি না। আমার কথা দ্বারা বায়ুর যে কম্পন হইতেছে, তাহা তােমার কর্ণে গিয়া তােমার স্নায়ুগুলি স্পর্শ করিতেছে এবং তােমার মনের উপর
প্রভাব বিস্তার করিতেছে।' তুমি ইহার প্রতিরােধ করিতে পার না। ইহা অপেক্ষা অধিকতর আশ্চর্য আর কি হইতে পারে? এক ব্যক্তি আর এক ব্যক্তিকে ‘মূখ বলিল—অমনি সে উঠিয়া মুষ্টি বদ্ধ করিয়া, তাহার নাকে ঘুষি
মারিল। দেখ শব্দের কি শক্তি! ঐ এক নারী দুঃখে কষ্টে কাদিতেছে ; আর এক নারী আসিয়া তাহাকে দুই-চারিটি মিষ্ট কথা শুনাইলেন। অমনি সেই
রােদনপরায়ণা নারীর বক্ৰদেহ সঙ্গে সঙ্গে সােজা হইল, তাহার শােক-দুঃখ চলিয়া গেল, তাহার মুখে হাসি দেখা দিল। দেখ, শব্দের কি শক্তি! উচ্চ
দর্শনে যেমন, সাধারণ জীবনেও তেমনি শব্দের প্রচণ্ড শক্তি। এ-সম্বন্ধে বিশেষ চিন্তা ও অনুসন্ধান না করিয়াও আমরা দিবারাত্র এই শক্তি লইয়া
নাড়াচাড়া করিতেছি। এই শক্তির প্রকৃতি অবগত হওয়া এবং যথাযথভাবে উহার ব্যবহার করা কর্মযােগের অঙ্গবিশেষ। অপরের প্রতি আমাদের কর্তব্যের অর্থ—অপরকে সাহায্য করা, জগতের উপকার করা। কেন আমরা জগতের উপকার করিব আপাততঃ বােধ হয়
যে, আমরা জগৎকে সাহায্য করিতেছি, বাস্তবিক কিন্তু আমরা নিজেদেরই সাহায্য করিতেছি। আমাদের সর্বদাই জগতের উপকার করিবার চেষ্টা করা
আবশ্যক, ইহাই যেন আমাদের কর্মপ্রবৃত্তির শ্রেষ্ঠ প্রেরণা হয়; কিন্তু যদি আমরা বিশেষ বিচার করিয়া দেখি, তবে দেখিব, আমাদের নিকট হইতে এই
জগতের কোন সাহায্যেরই প্রয়ােজন নাই। তুমি আমি আসিয়া উপকার করিব বলিয়া এই জগৎ সৃষ্ট হয় নাই। আমি একবার এক (খ্রীস্টীয়) ধর্মোপদেশে
পড়িয়াছিলাম, এই সুন্দর জগৎ অতি মঙ্গলময়, কারণ এখানে আমরা অপরকে সাহায্য করিবার সময় ও সুবিধা পাই। বাহ্যতঃ ইহা অতি সুন্দর ভাব
বটে, কিন্তু জগতে আমাদের সাহায্য প্রয়ােজন—এইরূপ বলা কি ঈশ্বরনিন্দা নয়? অবশ্য জগতে যে যথেষ্ট দুঃখ আছে, তাহা আমরা অস্বীকার করিতে
পারি না। সুতরাং আমরা যত কাজ করি, তাহার মধ্যে অপরকে সাহায্য করাই সর্বাপেক্ষা ভাল কাজ। যদিও আমরা শেষ পর্যন্ত দেখিব পরকে সাহায্য
করা নিজেরই উপকার করা। বালাকালে আমার কতকগুলি সাদা ইদুর ছিল। সেগুলি থাকিত একটি ছােট বাঝে, তাহাতে ছােট ছােট চাকা ছিল। ইদুরগুলি।
যেই চাকার উপর দিয়া পার হইতে চেষ্টা করিত, অমনি চাকাগুলি ক্রমাগত ঘুরিত, ইদুরগুলি আর অগ্রসর হইতে পারিত না। এই জগৎ এবং উহাকে
সাহায্য করাও সেইরূপ। তবে এইটুকু উপকার হয় যে, আমাদের মানসিক। শিক্ষা হয়। এই জগৎ ভালও নয়, মন্দও নয় ; প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজের জন্য
একটি জগৎ সৃষ্টি করে। অন্ধ ব্যক্তি যদি জগৎ-সম্বন্ধে ভাবিতে আরম্ভ করে , তবে তাহার কাছে জগৎ—হয় নরম বা শক্ত, ঠাণ্ডা বা গরমরূপে প্রতিভাত
হইবে। আমরা একরাশ সুখ বা দুঃখের সমষ্টিমাত্র। আমরা জীবনে শত শত বার ইহা অনুভব করিয়াছি। যুবকেরা সাধারণতঃ সুখবাদী (optimist), এবং
বৃন্ধেরা দুঃখবাদী (pessimist) হইয়া থাকে। যুবকদের সম্মুখে সারাটা জীবন পড়িয়া রহিয়াছে ; বৃদ্ধেরা কেবল অসন্তাষ প্রকাশ করে তাহাদের দিন ফুরাইয়াছে, শত শত বাসনা তাহাদের হৃদয় আলােড়িত করিতেছে, কিন্তু এখন সেগুলি পূরণ করিবার সামর্থ্য তাহাদের নাই। দুজনেই মূখ। আমরা যেরূপ স্বরূপতঃ এই জীবন ভালও নয়, মন্দও নয়। স্বরূপতঃ অগ্নি জিনিসটি ভালও
মন লইয়া জীবনকে দেখি, উহা সেইরূপেই প্রতীয়মান হইয়া থাকে, নতুবা নয়, মন্দও নয়। যখন উহা আমাদিগকে সুখতপ্ত রাখে, তখন আমরা
বলি—অগ্নি কি সুন্দর! আবার যখন উহা আমাদের অঙ্গুলি দগ্ধ করে, তখন আমরা অগ্নির নিন্দা করিয়া থাকি। অগ্নি কিন্তু স্বরূপতঃ ভালও নয়, মন্দও
নয়। আমরা উহার যেমন ব্যবহার করি, উহাও সেইরূপ ভাল-মন্দ ভাব জাগ্রত করে; জগৎ-সম্বন্ধেও এইরূপ। জগৎ স্বয়ংসম্পূর্ণ; এ-কথার অর্থ—জগৎ নিজের সমুদয় প্রয়ােজন পূরণ করিতে সম্পূর্ণভাবে সমর্থ ।
আমরা একেবারে নিশ্চিন্ত থাকিতে পারি যে, আমাদের সাহায্য ছাড়াও জগৎ বেশ চলিয়া যাইবে, উহার উপকারের জন্য আমাদিগকে মাথা ঘামাইতে হইবে
তথাপি আমাদিগকে পরােপকার করিতে হইবে; ইহাই আমাদের কর্ম-প্রবৃত্তির সর্বোচ্চ প্রেরণা, কিন্তু আমাদের সর্বদাই জানা উচিত যে , পরােপকার করা এক পরম সুযােগ ও সৌভাগ্য। উচ্চ মঞ্চের উপর দাড়াইয়া
পাচটি পয়সা লইয়া গরিবকে বলিও না, ‘এই নে বেচারা’, বরং তাহার প্রতি কৃতজ্ঞ হও গরিব লােকটি আছে বলিয়া তাহাকে সাহায্য করিয়া তুমি
নিজের উপকার করিতে পারিতেছ। যে গ্রহণ করে সে ধন্য হয় না, যে দান করে সে-ই ধন্য হয়। তুমি যে তােমার দয়া ও করুণাশক্তি জগতে প্রয়ােগ করিয়া নিজেকে পবিত্র ও সিদ্ধ করিতে সমর্থ হইতেছ, এজন্য তুমি কৃতজ্ঞ হও। সব ভাল কাজই আমাদিগকে পবিত্র ও সিদ্ধ হইতে সহায়তা করে। আমরা খুব বেশি কি করিতে পারি ?—একটা হাসপাতাল, রাস্তা বা দাতব্য
আশ্রম নির্মাণ করিতে পারি! গরিব দুঃখীকে সাহায্য করিবার জন্য হয়তাে । আমরা বিশ-ত্রিশ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করিতে পারি, তাহার মধ্যে দশ লক্ষ
টাকায় একটা হাসপাতাল খুলিতে পারি, দশ লক্ষ টাকা নাচ-তামাশা-মদে খরচ । করিতে পারি এবং দশ লক্ষের অর্ধেক কর্মচারীরা চুরি করিতে পারে এবং
অবশিষ্ট অংশ হয়তাে গরিবদের কাছে পেীছিল। কিন্তু তাহাতেই বা হইল কি ? এক ঝটকায় পাচ মিনিটে সব উড়িয়া যাইতে পারে। তবে করিব কি? এক
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে রাস্তা, হাসপাতাল, নগর, বাড়ি সব উড়িয়া যাইতে পারে। অতএব এস, জগতের উপকার করিব—এই অজ্ঞানের কথা একেবারে
পরিত্যাগ করি। জগৎ তােমার বা আমার সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করিতেছেনা । তথাপি আমাদিগকে কার্য করিতে হইবে, সর্বদাই লােকের উপকার করিতে হইবে, কারণ উহা আমাদের পক্ষে এক আশীর্বাদস্বরূপ। কেবল এই তাহারা কেহই আমাদের এক পয়সা ধারে না; আমরাই তাহাদের নিকট ঋণী,
উপায়েই আমরা পূর্ণ হইতে পারি। আমরা যেসব ভিখারিকে সাহায্য করি , কারণ সে তাহার উপর আমাদের দয়াবৃত্তি অনুশীলন করিতে অনুমতি
দিয়াছে। আমরা জগতের কিছু উপকার করিয়াছি বা করিতে পারি, অথবা মুখের চিন্তা, আর ঐরূপ চিন্তা দুঃখজনক। আমরা মনে করি, আমরা
অমুক অমুক লােককে সাহায্য করিয়াছি—এরূপ চিন্তা করা সম্পূর্ণ ভুল। ইহা । কাহাকেও সাহায্য করিয়াছি ; এবং আশা করি, সে আমাকে ধন্যবাদ দিবে ;
আর সে ধন্যবাদ না দিলে আমরা মনে কষ্ট পাই। আমাদের কৃত উপকারের জন্য কেন আমরা প্রতিদান আশা করিব যাহাকে সাহায্য করিতেছ, তাহার
প্রতি কৃতজ্ঞ হও, তাহাতে ঈশ্বর বুদ্ধি কর। মানুষকে সাহায্য করিয়া ঈশ্বরের এবং সানন্দে জগতে কিছু ভাল কাজ করিতে পারিতাম। আসক্তিশুন্য হইয়া
বাস্তবিক অনাসক্ত হইতাম, তবে এই বৃথা আশাজনিত কষ্ট এড়াইতে পারিতাম উপাসনা করিতে পাওয়া কি আমাদের মহাসৌভাগ্য নয় , যদি আমরা কাজ করিলে অশান্তি বা দুঃখ কখনই আসিবে না। এই জগৎ সুখ-দুঃখ লইয়া। অনন্তকাল চলিতে থাকিবে এবং আমরা উহাকে সাহায্য করিবার জন্য কিছু
করি বা না করি, তাহাতে কিছুই আসে যায় না দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি গল্প বলিতেছিঃ

একজন গরিব লােকের কিছু অর্থের প্রয়ােজন ছিল। সে শুনিয়াছিল যে, কোনরূপে একটি ভূতকে বশীভূত করিতে পারিলে তাহাকে আজ্ঞা করিয়া সে
অর্থ বা যাহা কিছু চায়, সবই পাইতে পারে। অতএব সে একটি ভূত সংগ্রহ করিবার জন্য বড় ব্যস্ত হইয়া পড়িল। তাহাকে ভূত দিতে পারে এমন একটিলােক খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিল; অবশেষে মহা-যােগেশ্ব সম্পন্ন এক সাধুর সহিত তাহার দেখা হইল। সে ঐ সাধুর সাহায্য প্রার্থনা করিল। সাধু বলিলেন, ‘ভূত লইয়া তুমি কি করিবে সে বলিল, “আমার একটি ভূত চাই।
সে আমার হইয়া কাজকর্ম করিবে। কিরূপে একটি ভূত পাইব তাহার উপায় শিখাইয়া দিন, একটি ভূত আমার বিশেষ প্রয়ােজন। সাধু বলিলেন, ‘অত
বিক্ষুব্ধ হইও না, বাড়ি যাও। পরদিন সে পুনরায় সাধুর নিকট গিয়া কাদিয়া কাটিয়া বলিতে লাগিল, ‘আমাকে একটি ভূত দিন। কাজে সাহায্য করিবার
জন্য একটি ভূত আমার চাই-ই চাই।। অবশেষে সাধুটি বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “এই যাদুমন্ত্র লও; ইহা জপ
করিলে একটি ভূত আসিবে তাহাকে যাহা আদেশ করিবে, সে তাহাই করিবে। কিন্তু সাবধান, ভূত বড় ভয়ানক প্রাণী তাহাকে অবিরত কাজে ব্যস্ত
রাখিতে হয় ; তাহাকে কাজ দিতে না পারিলে সে তােমার প্রাণ লইবে।”লােকটি বলিল, “ইহা তো অতি সহজ ব্যাপার, আমি তাহাকে তাহার
জীবনব্যাপী কর্ম দিতে পারি।' এই বলিয়া সে এক বনে গিয়া অনেক দিন ভূত আসিয়া উপস্থিত হইল এবং বলিল, “আমি ভূত—আমি তােমার মন্ত্রবলে
ধরিয়া ঐ মন্ত্রটি জপ করিতে লাগিল ; অবশেষে তাহার সম্মুখে এক বিরাট। বশীভূত হইয়াছি; কিন্তু আমাকে সর্বদা কাজে নিযুক্ত রাখিতে হইবে। যে
মুহুর্তে কাজ দিতে না পারিবে, সেই মুহূর্তে তােমাকে সংহার করিব।' লােকটি বলিল, 'আমার জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণ করিয়া দাও।' ভূত বলিল, 'হা,
প্রাসাদ নির্মিত হইয়াছে।' লােকটি বলিল, “টাকা আনাে। ভূত বলিল, “এই নাও টাকা।' লােকটি বলিল, 'এই বন কাটিয়া এখানে একটি শহর তৈরি কর।"
ভূত বলিল, “তাহাও হইয়াছে। আর কিছু করিতে হইবে ?' তখন লােকটির ভয় হইল ; সে ভাবিতে লাগিল, 'ইহাকে তাে আর কোন কাজ দিবার নাই, এ তাে দেখিতেছি এক মুহূর্তে সব সম্পন্ন করে!' ভূত বলিল, 'আমাকে কিছু কাজ দাও, নইলে তােমায় খাইয়া ফেলিব।' ভূতকে আর কি কাজ দিবে
ভাবিয়া না পাইয়া বেচারা অতিশয় ভয় পাইল। ভয়ে দৌড়াইতে দৌড়াইতে সাধুর নিকট পৌছিয়া বলিল, “প্রভু, আমাকে রক্ষা করুন। সাধু জিজ্ঞাসা
করিলেন, 'ব্যাপার কি? লােকটি বলিল, ‘ভূতকে আমি আর কিছু কাজ দিতে পারিতেছি না। আমি যা বলি তাই সে মুহুর্তের মধ্যে সম্পন্ন করিয়া ফেলে ;
আর যদি তাহাকে কাজ না দিই তাহা হইলে আমাকে খাইয়া ফেলিবে বলিয়া ভয় দেখাইতেছে। ঠিক তখনই তােমাকে খাইয়া ফেলিব' বলিতে বলিতে ভূত আসিয়া হাজির হইল। খায় আর কি! লােকটি ভয়ে থর-থর করিয়া কাপিতে লাগিল এবং তাহার জীবন রক্ষার জন্য সাধুর নিকট প্রার্থনা করিতে
লাগিল। সাধু বলিলেন, “আচ্ছা, তােমার একটি উপায় করিতেছি । কুকুরটির দিকে চাহিয়া দেখ—উহার বাকা লেজ। শীঘ্র তরবারি বাহির করিয়া
উহার লেজটি কাটো। তারপর ভূতটিকে উহা সােজা করিতে দাও।' লােকটি কুকুরের লেজ কাটিয়া ভূতকে দিয়া বলিল, “ইহা সােজা করিয়া দাও।' ভূত
উহা লইয়া ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে সােজা করিল, কিন্তু যেমনি ছাড়িয়া দিল, অমনি উহা গুটাইয়া গেল। আবার সে অনেক পরিশ্রম করিয়া লেজটি
সােজা করিল–ছাড়িয়া দিতেই উহা গুটাইয়া গেল। আবার সে ধৈর্য সহকারে। লেজটি সােজা করিল, কিন্তু ছাড়িয়া দিবামাত্র উহা বাকিয়া গেল। এইরূপে
দিনের পর দিন সে পরিশ্রম করিতে লাগিল। অবশেষে ক্লান্ত হইয়া বলিতে লাগিল, জীবনে কখনাে এমন যন্ত্রণায় পড়ি নাই। আমি পুরাতন পাকা ভূত,
কিন্তু জীবনে কখনাে এমন বিপদে পড়ি নাই। অবশেষে লােকটিকে বলিল , এস তােমার সঙ্গে আপস করি। তুমি আমাকে ছাড়িয়া দাও, আমিও তােমাকে যাহা যাহা দিয়াছি সবই রাখিতে দিব, এবং প্রতিজ্ঞা করিব-কখনাে
তােমার অনিষ্ট করিব না। লােকটি খুব সন্তুষ্ট হইয়া আনন্দের সহিত এই চুক্তি স্বীকার করিল।।
এই জগৎটা কুকুরের কোকড়ান লেজের মতাে মানুষ শত শত বৎসর যাবৎ ইহা সােজা করিবার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু যখনই একটু ছাড়িয়া দেয়,
তখনই উহ আবার গুটাইয়া যায়। অন্যথা আর কিরূপ হইবে? প্রথমেই জানা উচিত, আসক্তিশূন্য হইয়া কিভাবে কাজ করিতে হয় ; তাহা হইলেই আর
গোড়ামি আসিবে না। যখন আমরা জানিতে পারি, এই জগৎ কুকুরের কোকড়ান লেজের মতাে, এবং উহা কখনাে সােজা হইবে না, তখনই আমরা
আর গোড়া হইব না । অনেক প্রকার গোঁড়া আছে—মদ্যপান-নিবারক, চুরুট-নিবারক ইত্যাদি।
এক সময়ে এই ক্লাসে একজন যুবতী মহিলা আসিতেন। তিনি এবং আর কয়েকজন মহিলা মিলিয়া শিকাগাের একটি হল-বাড়ি করিয়াছেন। সেখানে শ্রমজীবীদের কিছু কিছু সঙ্গীত ও ব্যায়াম শিখিবার বন্দোবস্ত আছে। একদিন তিনি আমাকে মদ্যপান ও ধূমপান প্রভৃতিতে যে অনিষ্ট হয়, তাহা বলিতেছিলেন। তিনি বলিলেন, এইসকল দোষের প্রতিকারের উপায় তিনি
জানেন। আমি সে উপায়টি কি জানিতে চাহিলে তিনি বলিলেন, 'আপনি কি হল-বাড়িটির কথা জানেন না তাহার কথা শুনিয়া মনে হয়, তাহার মতে
মানবজাতির যাহা কিছু অশুভ, ঐ 'হল-বাড়িটি” তাহার অব্যর্থ মহৌষধ। ভারতে কতকগুলি গোড়া আছেন, তাহারা মনে করেন, মেয়েদের যদি
একাধিক বিবাহের অনুমতি দেওয়া যায়, তবেই সব দুঃখ ঘুচিবে। এই সবই গোড়ামি; আর জ্ঞানী ব্যক্তি কখনাে গোড়া হইতে পারেন না। গোড়ারা ঠিক ঠিক কাজ করিতে পারে না। জগতে যদি গোড়ামি না
থাকিত, তবে জগৎ এখন যেরূপ উন্নতি করিতেছে, তদপেক্ষা অধিক উন্নতি করিত। গোড়ামি দ্বারা মানবজাতির উন্নতি হয়—এরূপ চিন্তা করা ভুল।
উৎপত্তি হয়, ফলে মানুষ পরস্পর বিরোধ করে এবং পরস্পরের প্রতি পক্ষান্তরে বরং উহাতে উন্নতির বিঘ্ন হয়, কারণ উহাতে ঘৃণা ও ক্রোধের সহানুভূতিহীন হইয়া যায়। আমরা যাহা করি বা আমাদের যাহা আছে, মনে
করি, তাহাই জগতে শ্রেষ্ঠ এবং যাহা আমাদের নাই, তাহার কোন মূল্য নাই। লেজের কথা মনে করিও। জগতের জন্য তােমার উদ্বিগ্ন অথবা বিনিদ্র
অতএব যখনই গোড়ামির ভাব আসিবে, তখন সর্বদাই সেই কুকুরের তােমার এই গোঁড়ামি থাকিবে না, কেবল তখনই তুমি ভালভাবে কাজ
হইবার প্রয়ােজন নাই ; তােমাকে ছাড়াই জগৎ ঠিক চলিয়া যাইবে। যখন করিতে পারিবে। যাহার মাথা খুব ঠাণ্ডা, যে শান্ত এবং সর্বদা উত্তমরূপে
বিচার করিয়া কাজ করে, যাহার স্নায়ু সহজে উত্তেজিত হয় না এবং যাহার গভীর প্রেম ও সহানুভূতি আছে, সে-ই সংসারে ভাল কাজ করে এবং এইরূপে নিজেরও কল্যাণসাধন করে। গোড়ার নির্বোধ সহানুভূতিহীন
তাহারা জগৎকে তাে সােজা করিতে পারেই না, নিজেরাও পবিত্রতা ও পূর্ণতা
লাভ করিতে পারে না । তােমাদের নিজেদের ইতিহাসে ‘মে-ফ্লাওয়ার জাহাজ হইতে আগত ব্যক্তিদের কথা কি স্মরণ নাই যখন তাহারা প্রথমে এদেশে আসেন, তখন
তাহারা পিউরিটান’ ছিলেন, নিজেদের খুব পবিত্র ও সাধু-প্রকৃতি মনে করিতেন। কিন্তু অতি শীঘ্রই তাহারা অপর ব্যক্তিদের প্রতি অত্যাচার আরম্ভ
করিলেন। মানবজাতির ইতিহাসে সর্বত্রই এরূপ দেখা যায়। যাহারা নিজেরা অত্যাচারের ভয়ে পলাইয়া আসে, তাহারাই আবার সুবিধা পাইলে অপরের উপর অত্যাচার আরম্ভ করে। আমি দুইটি অদ্ভুত জাহাজের কথা শুনিয়াছি—প্রথমে ‘নােয়ার আর্ক' ও দ্বিতীয় ‘মে-ফ্লাওয়ার'। ইহুদিরা বলেন, সমুদয় সৃষ্টি ‘নােয়ার আর্ক’ হইতে আসিয়াছে; আর মার্কিনেরা বলেন , জগতের প্রায় অর্ধেক লােক 'মে-ফ্লাওয়ার জাহাজ হইতে আসিয়াছে। এদেশে যাহার সহিত দেখা হয়, এমন খুব কম লােকই দেখিতে পাই, যে না বলে
তাহার পিতামহ বা প্রপিতামহ ‘মে-ফ্লাওয়ার জাহাজ হইতে আসেন নাই। এ আর এক রকমের গোড়ামি। গোড়াদের মধ্যে শতকরা অন্ততঃ নকইজনের
যকৃত দূষিত, অথবা তাহারা অজীর্ণরোগগ্রস্ত, অথবা তাহাদের কোন-না-কোন প্রকার ব্যাধি আছে। ক্রমশঃ চিকিৎসকেরাও বুঝিবেন যে, গোড়ামি একপ্রকার
রােগবিশেষ—আমি ইহা যথেষ্ট দেখিয়াছি। প্রভু আমাকে গােড়ামি হইতে রক্ষা করুন।
এই গোড়ামি-সম্বন্ধে আমার যতটুকু অভিজ্ঞতা আছে, তাহাতে মােটামুটি আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, আমাদের কোনপ্রকার গোড়া বা
একঘেয়ে সংস্কারকার্যের সহিত মিশিবার প্রয়ােজন নাই। তােমরা কি বলিতে চাও যে, মদ্যপান-নিবারক গোড়ারা মাতাল-বেচারাদের বাস্তবিক ভালবাসে?
কিছু লাভের প্রত্যাশা করে। যুদ্ধ শেষ হইবামাত্র ইহারা লুণ্ঠনে অগ্রসর হয়। গােড়াদের গোড়ামির কারণ এই যে, তাহারা এই গোড়ামি করিয়া নিজেরা এই গোড়ার দল হইতে বাহির হইয়া আসিতে পারিলেই শিখিবে—কিরূপে
প্রকৃতভাবে ভালবাসিতে হয় এবং সহানুভূতি করিতে হয়, তখনই তােমাদের পক্ষে মাতালের সহিত সহানুভূতি করা সম্ভব হইবে; তখনই বুঝিবে-সেও
তােমার মতাে একজন মানুষ ; তখনই তােমরা বুঝিতে চেষ্টা করিবে যে, নানা অবস্থাচক্রে পড়িয়া সে ক্রমশঃ অবনত হইয়াছে; আর বুঝিবে, যদি তুমি
তাহার মতাে অবস্থায় পড়িতে, হয়তাে আত্মহত্যা করিতে। আমার একটি নারীর কথা মনে হইতেছে—তাহার স্বামী ছিল ঘাের মাতাল। স্ত্রী লােকটি
আমার নিকট তাহার স্বামীর অতিরিক্ত পান দোষ সম্বন্ধে অভিযােগ করিত। আমার কিন্তু নিশ্চিত ধারণা অধিকাংশ লােক তাহাদের স্ত্রীর দোষে মাতাল
হইয়া থাকে। তােষামােদ করা আমার কাজ নয়, আমাকে সত্য বলিতে হইবে। যে-সকল অবাধ্য মেয়েদের মন হইতে সহ্যগুণ একেবারে চলিয়া
গিয়াছে এবং যাহারা স্বাধীনতা সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হইয়া বলিয়া । থাকে, তাহারা পুরুষদিগকে নিজের মুঠোর ভিতর রাখিবে, এবং যখনই
পুরুষেরা সাহস করিয়া তাহাদের অরুচিকর কথা বলে, তখনই চিৎকার করিতে থাকে এরূপ মেয়েরা জগতের মহা অকল্যাণস্বরূপ হইয়া দাড়াইতেছে, আর ইহাদের অত্যাচারে জগতের অর্ধেক লােক যে এখনাে কেন
আত্মহত্যা করিতেছে না, ইহাই আশ্চর্যের বিষয়। এই নারীগণ অর্ধশিনপীড়িত প্রচারকগণকে তাহাদের দিকে টানিয়া লইতেছে; আর তাহারাও বলিতেছে,
“মহিলাগণ, আপনারাই জগতের সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য জীব।' তখন আবার ঐ রমণীগণ এই প্রচারকদের সম্বন্ধে বলিতে থাকে, 'ইনিই আমাদের পক্ষের
প্রচারক, আর তাহাকে টাকাকড়ি ও অন্যান্য আবশ্যক দ্রব্যাদি দিতে থাকে। এইরূপেই জগৎ চলিতেছে; কিন্তু জীবনটা তাে এরূপ একটা তামাশা নয় ;
জীবনে গভীরভাবে প্রণিধান ও আলােচনা করিবার বিষয় অনেক আছে। এখন তােমাদিগকে আজিকার বক্তৃতার মুখ্য বিষয়গুলি পুনরালােচনা
করিতে বলিতেছি। প্রথমতঃ আমাদিগকে মনে রাখিতে হইবে যে, আমরা সকলেই জগতের নিকট ঋণী ; জগৎ আমাদের নিকট এতটুকু ঋণী নয়।
আমাদের সকলেরই মহা সৌভাগ্য যে, আমরা জগতের জন্য কিছু করিবার সুযােগ পাইয়াছি। জগৎকে সাহায্য করিতে গিয়া আমরা প্রকৃতপক্ষে নিজেদেরই কল্যাণ করিয়া থাকি। দ্বিতীয়তঃ এই জগতে একজন ঈশ্বর
আছেন। ইহা সত্য নয় যে, এই জগং স্রোতে ভাসিয়া চলিয়াছে এবং তােমার বা আমার সাহায্যের অপেক্ষায় রহিয়াছে। ঈশ্বর জগতে সর্বদাই বর্তমান। তিনি অবিনাশী, নিয়ত ক্রিয়াশীল, তাহার সতর্কদৃষ্টি সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। যখন বিশ্ব জগাহ নিদ্রা যায়, তখনাে তিনি জাগিয়া থাকেন। তিনি অবিরত কাজ করিতেছেন। জগতে যাহা কিছু পরিবর্তন ও বিকাশ দেখা যায়, সবই তাহার কাজ। তৃতীয়তঃ আমাদের কাহাকেও ঘৃণা করা উচিত নয়। এই জগৎ চিরকাল শুভাশুভ মিশ্রিত হইয়া থাকিবে। আমাদের কর্তব্য—দুর্বলের প্রতি
সহানুভূতি প্রকাশ করা এবং অনিষ্টকারী কে ভালবাসা। এ জগৎ একটি বিরাট নৈতিক ব্যায়াম শালা—এখানে আমাদের সকলের অনুশীলন করতে হবে,
যাহাতে দিন দিন আমরা আরও বেশি আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ করিতে পারি। চতুর্থতঃ আমাদের কোনপ্রকারের গোড়া হওয়া উচিত নয়, কারণ গোড়ামি
প্রেমের বিপরীত। গোড়া ফস করিয়া বলিয়া বসে, ‘আমি পাপীকে ঘৃণা করি না , পাপকে ঘৃণা করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পাপ ও পাপীর মধ্যে পার্থক্য
করতে পারে, এমন মানুষ দেখার জন্য আমি দূরে-দূরান্তরে যেতে প্রস্তুত । এরূপ বলা খুব সহজ যদি আমরা উত্তমরূপে দ্রব্য ও গুণের মধ্যে পার্থক্য
করিতে পারি, তবে তো আমরা সিদ্ধ হইয়া যাই। এরূপ করা বড় সহজ নয়। অধিকন্তু যতই আমরা ধীর স্থির হবে এবং আমাদের স্নায়ুসমূহ যতই শান্ত হইবে, ততই আমরা অধিকতর প্রেম সম্পন্ন হবে এবং আরও ভালরূপে কর্ম,  করিতে সমর্থ হব।।


...........................Life History.........................   

No comments:

Powered by Blogger.