কর্ম রহস্য : Swami Vivekananda : বাণী ও রচনা : প্রথম পর্ব : Life History

কর্ম রহস্য :Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History 

কর্ম রহস্য :Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History

কর্ম রহস্য স্বামী বিবেকান্দ   শরীরগত অভাব পূরণ করিয়া অপরকে সাহায্য করা মহৎ কর্ম বটে, কিন্তুঅভাব যত অধিক এবং সাহায্য যত সুদূরপ্রসারী, উপকারও তত মহত্তর। যদি

এক ঘণ্টার জন্য কোন ব্যক্তির অভাব দূর করিতে পারা যায়, অবশ্যই তাহার
উপকার করা হইল; যদি এক বৎসরের জন্য তাহার অভাব দূর করিতে পারা। যায়, তবে তাহা অধিকতর উপকার ; আর যদি চিরকালের জন্য অভাব দূর
করিতে পারা যায়, তবে তাহা মানুষের শ্রেষ্ঠ উপহার। একমাত্র অধ্যাত্মজ্ঞানই আমাদের সমুদয় দুঃখ চিরকালের জন্য দূর করতে পারে
অন্যান্য জ্ঞান অতি অল্প সময়ের জন্য অভাব পূরণ করে মাত্র। কেবল আত্মবিষয়ক জ্ঞান দ্বারাই অভাব-বৃত্তি চিরতরে বিনষ্ট হইতে পারে অতএব
আধ্যাত্মিক সাহায্য করাই মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ সাহায্য করা। মানুষকে যিনি পরমার্থ জ্ঞান প্রদান করিতে পারেন, তিনিই মানুষের শ্রেষ্ঠ উপকারক। আমরা দেখিতেও পাই, মানুষের আধ্যাত্মিক অভাব পূরণ করিবার জন্য যাহারা সাহায্য করিয়াছেন, তাহারাই সর্বাপেক্ষা শক্তিমান পুরুষ  কারণ আধ্যাত্মিকতাই
আমাদের জীবনে সকল কর্ম-প্রচেষ্টার প্রকৃত ভিত্তি। আধ্যাত্মিক দিক দিয়া যিনি সুস্থ ও সবল, ইচ্ছা করিলে তিনি অন্যান্য বিষয়েও দক্ষ হইতে পারেন।
ভিতরে আধ্যাত্মিক শক্তি না জাগা পর্যন্ত মানুষের শারীরিক অভাবগুলিও ঠিক ঠিক পূর্ণ হয় না। আধ্যাত্মিক উপকারের পরই হইতেছে বুদ্ধিবৃত্তির
উন্নতি-বিষয়ে সাহায্য। অন্ন-বস্ত্রদান অপেক্ষা জ্ঞানদান উচ্চতর প্রাণদান অপেক্ষাও উহা মহৎ, কারণ জ্ঞানই মানুষের প্রকৃত জীবন। অজ্ঞান মৃত্মতুল্য,
জ্ঞানই জীবন। জীবন যদি অন্ধকারে কাটাইতে হয় অজ্ঞান ও দুঃখের মধ্য দিয়া চলাই যদি জীবন হয়, তবে জীবনের কোন মূল্যই নাই ইহার পর। অবশ্য শারীরিক অভাব পূরণে সাহায্য করার স্থান। অতএব অপরকে সাহায্য শারীরিক সাহায্যই একমাত্র সাহায্য। শারীরিক সাহায্যের স্থান শুধু সর্বশেষে । করার বিষয় বিচার করিবার সময় আমরা যেন এই ভ্রমে পতিত না হই যে,
নয় সর্বনিম্নেও, কারণ ইহা স্থায়ী তৃপ্তি দিতে পারে না। ক্ষুধার্ত হইলে যে তখনই নিবৃত্ত হইবে, যখন আমার সর্ববিধ অভাব দূর হইবে। তখন ক্ষুধা।
কষ্ট পাই, খাইলেই তাহা চলিয়া যায় কিন্তু ক্ষুধা আবার ফিরিয়া আসে। দুঃখ করিতে পারিবে না। অতএব যাহা আমাদিগকে আধ্যাত্মিক-বলসম্পন্ন করে,
আমাকে কষ্ট দিতে পারিবে না। কোনরূপ দুঃখ বা যন্ত্রণা আমাকে বিচলিত তাহাই সর্বশ্রেষ্ঠ উপকার ; তারপর মানসিক উপকার, তারপর শারীরিক।
মানুষের প্রকৃতি পরিবর্তিত হইতেছে, ততদিন এই শারীরিক অভাব গুলি কেবল শারীরিক সাহায্য দ্বারা জগতের দুঃখ দূর করা যায় না। যতদিন না
কর না কেন, কোনমতেই দুঃখ একেবারে দূর হইবে না। জগতের এই সর্বদাই আসিবে এবং দুঃখ অনুভূত হইবেই হইবে। যতই শারীরিক সাহায্য
দুঃখ-সমস্যার একমাত্র সমাধান মানবজাতিকে শদ্ধ ও পবিত্র করা। আমরা ইহাতে প্রসূত। মানুষকে অজ্ঞানালােক দাও, সকল মানুষ পবিত্র
জগতে যাহা কিছু দুঃখকষ্ট ও অশুভ দেখিতে পাই, সবই অজ্ঞান বা অবিদ্যা আধ্যাত্মিক-বলসম্পন্ন ও শিক্ষিত হউক, কেবল তখনই জগৎ হইতে দুঃখ।
নিবৃত্ত হইবে, তাহার পূর্বে নয়। দেশে প্রত্যেকটি গৃহকে আমরা দাতব্য আশ্রমে পরিণত করিতে পারি, হাসপাতালে দেশ ছাইয়া ফেলিতে পারি, কিন্তু
যতদিন না মানুষের স্বভাব বদলাইতেছে, ততদিন দুঃখকষ্ট থাকিবেই থাকিবে। গীতায় আমরা পুনঃ পুনঃ পাঠ করি আমাদিগকে অবিরত কর্ম করিতে
হইবে। সকল কর্মই স্বভাবতঃ শুভাশুভ-মিশ্রিত। আমরা এমন কোন কর্ম করিতে পারি না, যাহা দ্বারা কোথাও কিছু না-কিছু ভাল হয়, আবার এমন কোন কর্ম হইতে পারে না, যাহা হইতে কোথাও না কোথাও কিছু অনিষ্ট হয়। প্রত্যেক কর্মই অপরিহার্যভাবে শুভাশুভ-মিশ্রিত, তথাপি শাস্ত্র আমাদিগকে অবিরত কর্ম করিতে বলিতেছেন। শুভাশুভ উভয়ই নিজ নিজ ফল প্রসব
করিবে। শুভ কর্মের ফল শুভ, অশুভ কর্মের ফল অশুভ হইবে । কিন্তু এই শুভাশুভ উভয়ই আত্মার বন্ধন। গীতায় ইহার এই মীমাংসা করা হইয়াছে যে,
যদি আমরা কর্মে আসক্ত না হই, তবে কর্ম আমাদের বন্ধন হইতে পারিবে না। এখন ‘কর্মে অনাসক্তি' বলিতে কি বুঝায়, আমরা তাহাই বুঝিতে চেষ্টা
‘সংস্কার' শব্দের প্রায় কাছাকাছি অর্থ ‘সহজাত প্রবণতা'। মনকে যদি একটি হ্রদের সহিত তুলনা করা হয়, তাবে বলা যায়—মনের মধ্যে যে-কোন তরঙ্গ
করিব। গীতার মূলভাব এই  নিরন্তর কর্ম কর, কিন্তু তাহাতে আসক্ত হইও না।
উঠে, তাহা প্রশমিত হইলেও একেবারে লুপ্ত হয় না, কিন্তু উহা চিত্তের উপর দাগ এবং ঐ তরঙ্গের পুনরাবির্ভাবের সম্ভাবনার একত্র নাম ‘সংস্কার'।
একটি দাগ রাখিয়া যায় এবং সেই তরঙ্গটির পুনরাবির্ভাব-সম্ভাবনা থাকে। এই আমরা যে কোন কর্ম করি আমাদের প্রত্যেক অঙ্গ-সল্লালন, আমাদের
প্রত্যেক চিন্তা চিত্তের উপর এইরূপ সংস্কার রাখিয়া যায় যখন সংস্কারগুলি উপরিভাগে থাকে না, তখনাে এত প্রবল থাকে যে, তাহারা অবচেতন মনে
অজ্ঞাতসারে কার্য করিতে থাকে। আমরা প্রতি মুহূর্তে যাহা, তাহা আমাদের মনের উপর এই সংস্কার-সমষ্টির দ্বারা নিরূপিত হয়। এই মুহূর্তে আমার
‘আমি’ বলিতে যাহা বুঝায়, তাহা আমার অতীত জীবনের সংস্কার-সমষ্টির ফল মাত্র। ইহাকেই প্রকৃতপক্ষে চরিত্র বলে। প্রত্যেক ব্যক্তির চরিত্র এই
সংস্কার-সমষ্টির দ্বারা নিরূপিত হয়। যদি শুভ সংস্কারগুলি প্রবল হয়, তবে চরিত্র সৎ হয় ; অসৎ সংস্কারগুলি প্রবল হইলে চরিত্র অসৎ হয়। যদি কোন
ব্যক্তি সর্বদা মন্দ কথা শােনে, মন্দ চিন্তা করে, মন্দ কাজ করে, তাহার মন মন্দ সংস্কারে পূর্ণ হইয়া যাইবে এবং ঐগুলিই অজ্ঞাতসারে তাহার কর্ম ও
চিন্তাকে প্রভাবিত করিবে। বাস্তবিক পক্ষে এই মন্দ সংস্কারগুলি সর্বদাই কাজ করিতেছে, সুতরাং ইহাদের ফলও মন্দ হইবে এবং ঐ ব্যক্তি একটি মন্দ লােক
হইয়া দাড়াইবে সে ঐরূপ না হইয়া পারে না। তাহার মনের এই সংস্কার-সমষ্টি মন্দ কাজ করিবার প্রবল প্রেরণা-শক্তি উৎপন্ন করিবে। এই সংস্কারগুলির হাতে সে যন্ত্রতুল্য হইবে, এগুলি তাহাকে জোর করিয়া মন্দ কার্যে প্রবৃত্ত করিবে। এইরূপে যদি কেহ ভাল বিষয়ে চিন্তা করে এবং ভাল কাজ করে, সংস্কারগুলির সমষ্টি ভালই হইবে এবং অনুরূপভাবে ঐগুলি
অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঐ ব্যক্তিকে সকার্যে প্রবৃত্ত করিবে। যখন মানুষ এত বেশি ভাল কাজ করে এবং এত বেশি সৎ চিন্তা করে যে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাহার প্রকৃতিতে সৎ কার্য করিবার অদম্য ইচ্ছা জাগ্রত হয়, তখন সে কোন অন্যায় কার্য করিতে ইচ্ছা করিলেও ঐ সকল সংস্কারের সমষ্টি-স্বরূপ তাহার মন তাহাকে উহা করিতে দিবে না, সংস্কারগুলিই তাহাকে মন্দ কর্ম হইতে
ফিরাইয়া আনিবে ; সে তখন তাহার সং সংস্কারগুলি দ্বারা সম্পূর্ণরূপে বলা যায় প্রভাবিত হয়। যখন এইরূপ হয়, তখনই সেই ব্যক্তির চরিত্র গঠিত হইয়াছে।
যেমন কর্ম তাহার পা ও মাথা খােলার ভিতরে গুটাইয়া রাখে তাহাকে মারিয়া ফেলিতে পার, খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিতে পার, তথাপি পা ও মাথা
বাহিরে আসিবে না, তেমনি যে ব্যক্তির ইন্দ্রিয় ও প্রবৃত্তিগুলি সংযত হইয়াছে , তাহার চরিত্রও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। সে তাহার অন্তরিন্দ্রিয়গুলি সংযত
করিয়াছে, তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কিছুই সেগুলিকে বহির্মুখী করিতে পারে না। এরূপ নিরন্তর সচ্চিন্তার প্রতিক্রিয়া দ্বারা শুভ সংস্কারগুলি তাহার
মনের উপরিভাগে সর্বদা আবর্তিত হওয়ায় সৎকর্ম করিবার প্রবণতা প্রবল হয়  তাহার ফলে এই হয় যে, আমরা ইন্দ্রিয়গুলি (জ্ঞানেন্দ্রিয়ের যন্ত্র ও
স্নায়ুকেন্দ্র) জয় করিতে সমর্থ হই। এভাবেই চরিত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তখনই মানুষ সত্য লাভ করিতে পারে। এরূপ লােকই চিরকালের জন্য নিরাপদ
তাহার দ্বারা কোন অন্যায় অশুভ কার্য সম্ভব হয় না। তাহাকে যেরূপ সঙ্গেই রাখ না কেন, তাহার কোন বিপদের সম্ভাবনা নাই। এই সংপ্রবৃত্তি-সম্পন্ন
হওয়া অপেক্ষা আরও এক উচ্চতর অবস্থা আছে-মুমুক্ষুত্ব। তােমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে, সকল যােগের লক্ষ্য আত্মার মুক্তি এবং প্রত্যেক যােগই
সমভাবে একই লক্ষ্যে লইয়া যায়। বৌদ্ধ প্রধানতঃ ধ্যানের দ্বারা, খ্রীষ্ট প্রার্থনা দ্বারা যে অবস্থা লাভ করিয়াছেন, মানুষ কেবল কর্মের দ্বারাই সেই অবস্থা
লাভ করিতে পারে। বুদ্ধ ছিলেন কর্ম পরায়ণ জ্ঞানী, আর খ্রীস্ট ছিলেন ভক্ত কিন্তু উভয়ে একই লক্ষ্যে উপনীত হয়েছিলেন। তাকে বোঝা কঠিন। মুক্তির
অর্থ সম্পূর্ণ স্বাধীনতা যেমন অশুভ বন্ধন হইতে, তেমনি শুভ বন্ধন হইতেও মুক্তি। সােনার শিকলও শিকল, লােহার শিকলও শিকল। আমার
আঙুলে একটি কাটা ফুটিয়াছে, আর একটি কাটা দ্বারা ঐ কাটাটি তুলিয়া ফেলিলাম, তােলা হইয়া গেলে দুটি কাটাই ফেলিয়া দিলাম। দ্বিতীয় কাটাটি
রাখিবার দরকার নাই, কারণ দুটিই তাে কাটা এইরূপ অশুভ সংস্কারগুলি শুভ সংস্কার দ্বারা ব্যাহত করিতে হইবে। মনের মন্দ সংস্কারগুলি দূরীভূত
করিয়া সেখানে ভাল সংস্কারের তরঙ্গ প্রবাহিত করিতে হইবে যতদিন না যাহা কিছু মন্দ, তাহা প্রায় অন্তর্হিত হয়, অথবা নিয়ন্ত্রিত হইয়া মনের
এক কোণে বশীভূত ভাবে থাকে। কিন্তু তারপর শুভ সংস্কারগুলি জয় করিতে হইবে। এরূপে ‘আসক্ত’ মন ক্রমে ‘অনাসক্ত হইয়া যায়। কর্ম কর,
কিন্তু এ কর্ম বা চিন্তা যেন মনের উপর কোন গভীর সংস্কার উৎপন্না না করে। ছােট ছােট তরঙ্গ আসুক, পেশী ও মস্তিষ্ক হইতে বড় বড় কর্মতরঙ্গ উৎপন্ন
হউক, কিন্তু তাহারা যেন আত্মার উপর গভীর সংস্কার উৎপন্ন না করে । ইহা করিবার উপায় কি? আমরা দেখিতে পাই, যে কার্যে আমরা আসক্ত
হই, তাহারই সংস্কার থাকিয়া যায়। সারা দিনে শত শত ব্যক্তিকে দেখিয়াছি ,তাহাদের মধ্যে এমন একজনকে দেখিয়াছি, যাহাকে আমি ভালবাসি। রাত্রে
যখন শয়ন করিতে গেলাম, তখন আমার দৃষ্ট মুখগুলির বিষয় চিন্তা করিবার চেষ্টা করিতে পারি কিন্তু এক মিনিটের জন্য যে-মুখখানি দেখিয়াছিলাম,
যাহাকে আমি ভালবাসি, সেই মুখখানিই আমার মনে ভাসিয়া উঠিল, আর সব মুখগুলি কোথায় অন্তর্হিত হইল। ঐ ব্যক্তির প্রতি আমার বিশেষ আসক্তিবশতঃ অন্যান্য মুখগুলি অপেক্ষা ঐ মুখখানিই আমার মনে গভীর চিহ্ন রাখিয়া গিয়াছে। শারীরিক দিক দিয়া মুখগুলি দেখার কাজ একরূপই, যে মুখগুলি আমি দেখিয়াছি সবগুলির ছবিই আমার অক্ষিজালের উপর পড়িয়াছিল, মস্তিষ্ক ঐ ছবি গ্রহণ করিয়াছিল, কিন্তু মনের উপর উহাদের সব নুতন মুখ হয়তাে দেখিয়াছি, যেগুলি সম্বন্ধে আমি পূর্বে কখনাে চিন্তাই প্রভাব একরূপ হয় নাই। বেশির ভাগ মুখ হয়তাে সম্পূর্ণ নূতন ছিল; এমন করি নাই; কিন্তু যে-মুখখানির একবার মাত্র চকিত দর্শন পাইয়াছি, তাহার সহিত চিত্তের বিশেষ যােগাযােগ ছিল। হয়তাে কত বৎসর ধরিয়া মনে মনে
তাহার ছবি, আঁকিতেছিলাম, তাহার সম্বন্ধে শত শত বিষয় জানিতাম, এখন এই নূতন করিয়া দেখায় মনের শত শত স্মৃতি জাগিয়া উঠিল। অন্য বিভিন্ন
মুখগুলি দেখার সমবেত ফলে মনে যে সংস্কার পড়িয়াছে, ঐ একখানি মুখ মানস পটে তদপেক্ষা শতগুণ অধিক সংস্কার ফেলিয়া মনের উপর দারুণ
প্রভাব বিস্তার করিবে। অতএব ‘অনাসক্ত হও, সব ব্যাপার চলিতে থাকুক, মস্তিষ্ক-কেন্দ্রগুলি কর্ম
করুক। নিরন্তর কর্ম কর, কিন্তু একটি তরঙ্গও যেন মনকে পরাভূত না করিতে পারে। তুমি যেন সংসারের বিদেশী পথিক, যেন দুদিনের জন্য
আসিয়াছ এইভাবে কর্ম করিয়া যাও। নিরন্তর কর্ম কর, কিন্তু নিজেকে বন্ধনে ফেলিও না, বন্ধন বড় ভয়ানক। এই জগৎ আমাদের বাসভূমি নয়।
নানা অবস্থার ভিতর দিয়া আমরা চলিয়াছি, এই সংসার এ পৃথিবী সেগুলিরই একটি। সাংখ্যের সেই মহাবাক্য স্মরণ রাখিও 'সমুদয় প্রকৃতি আত্মার জন্য, আত্মা প্রকৃতির জন্য নয়। আত্মার শিক্ষার জন্যই প্রকৃতির
প্রয়ােজন। ইহার অন্য কোন অর্থ নাই। আত্মা যাহাতে জ্ঞানলাভ করিতে পারে এবং জ্ঞানের দ্বারাই আত্মা নিজেকে মুক্ত করিতে পারে ইহাই
প্রয়ােজন। যদি সর্বদাই একথা স্মরণ রাখি, তবে কখনই প্রকৃতিতে আসক্ত হইব না, আমরা বুঝিব যে, প্রকৃতি আমাদের একটি পাঠ্যপুস্তকমাত্র। উহা
হইতে জ্ঞানলাভ করিবার পর, আমাদের নিকট ঐ গ্রন্থের আর কোন মূল্য থাকে না। তাহা না করিয়া প্রকৃতির সহিত আমরা নিজেদের মিশাইয়া
ফেলিতেছি, ভাবিতেছি আত্মাই প্রকৃতির জন্য। চলিত কথায় আছে, আমরাও মনে করি মানুষ খাবার জন্যই বাচে', 'বাচার জন্য যে খায় তা নয়।
আমরা ক্রমাগত এই ভুল করিতেছি ; প্রকৃতিকেই ‘আমি’ ভাবিয়া উহাতে আসক্ত হইতেছি। এই আসক্তি হইতেই আত্মার উপর গভীর সংস্কার পড়ে।
এই সংস্কারই আমাদিগকে বদ্ধ করে এবং স্বাধীনভাবে কর্ম করিতে না দিয়া ক্রীতদাসের মতাে কর্ম করায়।
এই শিক্ষার সারমর্ম এই যে প্রভুর মতাে কর্ম করিতে হইবে, ক্রীতদাসের মতাে নয়। সর্বদা কর্ম কর, কিন্তু দাসের মতাে কর্ম করিও না। সকলে
কিভাবে কর্ম করিতেছে, তাহা কি দেখিতেছ না? কেহই সম্পূর্ণভাবে কর্মহীন হইতে পারে না। শতকরা নিরানব্বই জন লােক ক্রীতদাসের মতাে কর্ম থাকে তাহার ফল দুঃখ : ঐরূপ কর্ম স্বার্থপর। স্বাধীনতার সহিত কাজ কর,প্রেমের সহিত কাজ কর। প্রেম' শব্দটি হৃদয়ঙ্গম করা বড় কঠিন। স্বাধীনতা না থাকিলে কখনাে প্রেম আসিতে পারে না। ক্রীতদাসের পক্ষে যথার্থ প্রেম
সম্ভব নয়। একটি ক্রীতদাস কিনিয়া শৃঙ্খলে বাধিয়া তাহাকে দিয়া কাজ করাও , সে বাধ্য হইয়া একটানাভাবে কাজ করিবে, কিন্তু তাহার অন্তরে কোন
ভালবাসা থাকিবে না। এইরূপ আমরাও যখন সাংসারিক ব্যাপারে ক্রীতদাসের মতাে কাজ করি, আমাদেরও অন্তরে কোন ভালবাসা থাকে না আমাদের
এই কাজ প্রকৃত কর্ম নয়। আমাদের আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবের জন্য আমরা যে সম্বন্ধেও ঐ কথা খাটে।
কাজ করি, এমন-কি, আমাদের নিজেদের জন্য যে কাজ করি, তাহার স্বার্থের জন্য কৃত কর্ম দাসসুলভ কর্ম, আর কোন কর্ম স্বার্থের জন্য কৃত কিনা, তাহার পরীক্ষা এই যে, প্রেমের সহিত যে-কোন কাজ করা যায়,
তাহাতে সুখই হইয়া থাকে। প্রেম-প্রণােদিত এমন কোন কাজ নাই, যাহার ফলে শান্তি ও আনন্দ না আসে। প্রকৃত সত্তা, প্রকৃত জ্ঞান, প্রকৃত প্রেম
অনন্তকালের জন্য পরম্পর-সম্বন্ধ ইহারা একে তিন। ইহাদের একটি যেখানে আছে, অপরগুলি সেখানে অবশ্য থাকিবে। ইহারা সেই অদ্বিতীয়
সচ্চিদানন্দেরই ত্রিবিধ রূপ। যখন সেই (নিরপেক্ষ) সত্তা আপেক্ষিক ভাবাপন্ন হয়, তখন উহাকে আমরা জগৎরূপে দেখিয়া থাকি। সেই জ্ঞানই আবার
জাগতিক বস্তু বিষয়ক জ্ঞানে পরিবর্তিত হয় এবং সেই আনন্দই মানবহৃদয়ে প্রেমাস্পদ কাহারও দুঃখের কারণ হইতে পারে না । সর্ববিধ ভালবাসার ভিত্তিস্বরূপ। অতএব প্রকৃত প্রেম কখনাে প্রেমিক অথবা
পরিপূর্ণভাবে ভােগ করিতে চায় ; তাহার প্রতিটি গতিবিধি সম্বন্ধে পুরুষটির মনে কর, একজন পুরুষ একটি মেয়েকে ভালবাসে। সে একাই তাহাকে
মনে ঈষরি উদয় হয়। সে চায় মেয়েটি তাহার কাছে বসুক, তাহার কাছে দাঁড়াক, তাহার ইঙ্গিতে খাওয়া-দাওয়া, চলা-ফেরা প্রভৃতি সব কাজ করুক।
সে ঐ মেয়েটির ক্রীতদাস, এবং মেয়েটিকেও নিজের দাসী করিয়া রাখিতে চায়। ইহা ভালবাসা নয়, ইহা একপ্রকার দাসসুলভ অনুরাগের বিকার।
Life history more.... 


...........................Life History........................

No comments:

Powered by Blogger.