অনাসক্তি পূর্ণ আত্মত্যাগ :স্বামী বিবেকানন্দ : বাণী ও রচনা : প্রথম পর্ব :Life History

অনাসক্তি পূর্ণ আত্মত্যাগ : Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History
Swami vivekananda 
অনাসক্তি পূর্ণ আত্মত্যাগ : Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History  

আমাদের ভিতর হইতে বহির্গত অর্থাৎ আমাদের কায় মন ও বাক্য দ্বারা কৃত প্রত্যেক কার্যই যেমন আবার প্রতিক্রিয়ারূপে আমাদের নিকট ফিরিয়া আসে, সেইরূপ আমাদের কার্য অপর ব্যক্তির উপর এবং তাহাদের কার্য আমাদের উপর প্রভাব বিস্তার করিতে পারে। তােমরা হয়তাে সকলেই লক্ষ্য করিয়া থাকিবে যে, কেহ যখন কোন মন্দ কাজ করে, তখন সে ক্রমশঃ
আরও মন্দ হইতে থাকে এবং যখন সৎকার্য করিতে আরম্ভ করে, তখন তাহার অন্তরাত্মা দিন দিন সবল হইতে সবলতর হইতে থাকে সর্বদাই ভাল।
কাজ করিতে প্রবৃত্ত হয়। এক মন আর এক মনের উপর কার্য করে এই তত্ত্ব ব্যতীত কর্মের প্রভাবের এই শক্তিবৃদ্ধি আর কোন উপায়েই ব্যাখ্যা করা
যাইতে পারে না। পদার্থবিজ্ঞান হইতে একটি উপমা গ্রহণ করিলে বলা যায়,  যে আমি যখন কোন কর্ম করিতেছি, তখন আমার মন কোন নির্দিষ্ট কম্পনের
অবস্থায় রহিয়াছে ; এরূপ অবস্থাপন্ন সকল মনেই আমার মন দ্বারা প্রভাবিত হইবার প্রবণতা আছে। যদি কোন ঘরে একসুরে বাধা বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র থাকে,
তাহার একটিতে আঘাত করিলে অপরগুলিরও সেই সুরে বাজিয়া উঠিবার প্রবণতা হয়তাে লক্ষ্য করিয়াছ। এইরূপ যে-সকল মন একসুরে বাধা, একরূপ
চিন্তা তাহাদের উপর সমভাবে কার্য করিবে। অবশ্য দূরত্ব ও অন্যান্য কারণে চিন্তার প্রভাবের তারতম্য হইবে, কিন্তু মনের প্রভাবিত হইবার সম্ভাবনা সর্বদা
থাকিবে। মনে কর, আমি কোন মন্দ কাজ করিতেছি, আমার মন কম্পনের এক বিশেষ সুরে রহিয়াছে, তাহা হইলে জগতের সেইরূপ কম্পন-বিশিষ্ট সকল মনেই আমার মন দ্বারা প্রভাবিত হইবার সম্ভাবনা থাকিবে। এইরূপে যখন আমি কোন ভাল কাজ করি, তখন আমার মন আর এক সুরে বাজিতেছে এবং সেই সুরে বাধা সকল মনই আমার মন দ্বারা প্রভাবিত হইতে
পারে। তানশক্তির তারতম্য অনুসারে মনের উপর মনের এই প্রভাব বিস্তারের শক্তিও কম-বেশি হয়।
এই উপমাটি লইয়া আরও একটু অগ্রসর হইলে বুঝা যাইবে যে, আলােক-তরঙ্গগুলি যেমন কোন বস্তুতে প্রতিহত হইবার পূর্বে লক্ষ লক্ষ বৎসর শূন্যমার্গে ভ্রমণ করিতে পারে, এই চিন্তাতরঙ্গগুলিও যতদিন না
সমভাবে স্পন্দিত হইবার মতাে একটি বস্তু লাভ করে, ততদিন হয়তাে শত শত বৎসর ঘুরিতে থাকিবে। খুব সম্ভব আমাদের এই বায়ুমণ্ডল এইরূপ ভাল-মন্দ উভয় প্রকার চিন্তাতরঙ্গে পরিপূর্ণ। বিভিন্ন মস্তিষ্ক হইতে প্রসূত
প্রত্যেকটি চিন্তাই যেন এইরূপ স্পন্দিত হইয়া ভ্রমণ করিতেছে যতদিন না উহা একটি উপযুক্ত আধার প্রাপ্ত হয়। যে-কোন চিত্ত এই আবেগসমুহের কিছু
গ্রহণ করিবার জন্য উন্মুক্ত হইয়াছে, সেই চিত্ত শীঘ্রই ঐভাবে স্পন্দিত হয় । সুতরাং যখন কেহ কোন অসৎ কর্ম করে, তখন তাহার মন এক বিশেষ স্তরে
উপনীত হয় ; আর সেই সুরের যে-সকল তরঙ্গ পূর্ব হইতেই বায়ুমণ্ডলেরহিয়াছে, সেগুলি তাহার মনে প্রবেশ করিবার চেষ্টা করে। এই জন্যই যে অসৎ কাজ করে, সে সাধারণতঃ দিন দিন আরও বেশি অসৎ কাজই করিতে থাকে। তাহার কর্ম ক্রমশঃ প্রবল হইতে থাকে। যে ভাল কাজ করে, তাহার পক্ষেও এইরূপ তাহার বায়ুমণ্ডলে শুভতরঙ্গ দ্বারা প্রভাবিত হইবার সম্ভাবনা ;
সুতরাং তাহার শুভকর্মগুলি অধিক শক্তিলাভ করিবে। অতএব অসৎ কর্ম করিতে গিয়া দুই প্রকার বিপদে আমরা পড়িতে পারি প্রথমতঃ আমাদের
চারিদিকের অসৎ প্রভাবগুলিতে আমরা যেন গা ঢালিয়া দিই ; দ্বিতীয়তঃ আমরা নিজেরা এরূপ সব অশুভ তরঙ্গ সৃষ্টি করি, যেগুলি শত শত বৎসর
পরেও অপরকে আক্রমণ করিতে পারে। হইতে পারে আমাদের অশুভ কার্য অপরকে আক্রমণ করিবে। অসৎ কর্ম করিয়া আমরা নিজেদের এবং অন্যেরও
অনিষ্ট করি । সৎ কর্ম করিয়া নিজেদের এবং অন্যেরও উপকার করি। অন্যান্য শক্তির ন্যায় মানুষের অভ্যন্তরস্থ এই সদসং শক্তিদ্বয়ও বাহির হইতে বল সঞ্চয় করে।
কর্মযােগের মতে কৃত কর্ম ফল প্রসব না করিয়া কখনই নষ্ট হইতে পারে না। প্রকৃতির কোন শক্তিই উহার ফলপ্রসব রােধ করিতে পারে না। কোন অসৎ কর্ম করিলে আমি তাহার জন্য ভুগিব ; জগতে এমন কোন শক্তি নাই যাহা উহাকে বােধ করিতে পারে। এইরূপে কোন সৎকর্ম করিলেও জগতে কোন শক্তিই উহার শুভ ফল রােধ করিতে পারে না। কারণ থাকিলে কার্য।
হইবেই ; কিছুই উহাকে বাধা দিতে পারে না—রােধ করিতে পারে না। এখন কর্মযােগ সম্বন্ধে একটি সূক্ষ্ম ও গুরুতর সমস্যা দেখা দিতেছে , যথা আমাদের এই সকল সদসৎ কর্ম পরস্পরের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে সম্বন্ধ।
আমরা একটি সীমারেখা টানিয়া বলিতে পারি না এই কাজটি সম্পূর্ণ ভাল , আর এইটি সম্পূর্ণ মন্দ। এমন কোন কর্ম নাই, যাহা একই কালে শুভ অশুভ দুই প্রকার ফলই প্রসব না করে। একটি নিকটের উদাহরণ লওয়া যাক আমি তােমাদের সঙ্গে কথা বলিতেছি ; তােমাদের মধ্যে হয়তাে কেহ কেহ ভাবিতেছে, আমি ভাল কাজ করিতেছি। কিন্তু ঐ একই সময়ে হয়তাে আমি
বায়ুমণ্ডলস্থ সহস্র সহস্র কাটাণু ধ্বংস করিতেছি। এইরূপে আমি কাহারও অনিষ্ট করিতেছি। যখন আমাদের কাজ নিকটস্থ পরিচিত ব্যক্তিদের উপর শুভ
প্রভাব বিস্তার করে, তখন আমরা ঐ কাজকে ভাল কাজ বলি। উদাহরণস্বরূপ দেখ, আমার এই বক্তৃতা তােমরা ভাল বলিতে পার, কীটাণুগুলি কিন্তু তা
বলিবে না। কীটাণুগুলিকে তােমরা দেখিতে পাইতেছ না, নিজেদেরই দেখিতে পাইতেছ। তােমাদের উপর কথা বলার প্রভাব প্রত্যক্ষ, কিন্তু কীটাণুগুলির
উপর উহার প্রভাব তত প্রত্যক্ষ নয়। এইরূপে যদি আমরা আমাদের অসৎ কর্মগুলি বিশ্লেষণ করিয়া দেখি, তবে দেখি-ঐগুলি দ্বারাও হয়তাে কোথাও কিছু না-কিছু শুভ ফল হইয়াছে। যিনি শুভ কর্মের মধ্যে কিছু অশুভ, আবার অনাসক্তিই পূর্ণ আত্মত্যাগ।
অশুভের মধ্যে কিঞ্চিৎ দেখেন, তিনিই প্রকৃত মরহস্য বুঝিয়াছেন। কিন্তু ইহা হইতে কি সিদ্ধান্ত করা যায়? সিদ্ধান্ত এই যে, আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন, এমন কোন কার্য হইতে পারে না, যাহা সম্পূর্ণ
অপবিত্র এখানে হিংসা বা অহিংসা এই অর্থে 'অপবিত্রতা' অথবা 'পবিত্রতা
গ্রহণ করিতে হইবে। পরে অনিষ্ট না করি। আমরা স্বাসপ্রশ্বাসত্যাগ বা জীবন ধারণ করিতে পারি না। আমাদের প্রত্যেক অগ্নমুষ্টি অপরের মুখ হইতে
কাড়িয়া লওয়া। আমরা বাচিয়া জগৎ জুড়িয়া থাকার দরুনই অপর কতক গুলি প্রাণীর কষ্ট হইতেছে ; হইতে পারে তাহারা মানুষ অথবা প্রাণী অথবা কীটাণু,
কিন্তু যাহারই হউক না, আমরা কোন-না-কোন প্রাণীর স্থান সঙ্কুচিত করিতেছি, স্থানসঙ্কোচ করিবার কারণ হইয়াছি। এইরূপই যদি হয়, তবে স্পষ্টই বুঝা
যাইতেছে যে, কর্ম দ্বারা কখনাে পূর্ণতা লাভ করা যায় না। আমরা অনন্তকাল কাজ করিয়া যাইতে পারি, কিন্তু এই জটিল সংসার-রাপ গােলকধাধা হইতে
বাহির হইবার পথ পাওয়া যাইবে না ; তুমি ক্রমাগত কাজ করিয়া যাইতে পার, কর্মফলে শুভ ও অশুভের অবশ্যম্ভাবী মিশ্রণের অন্ত নাই, দ্বিতীয় বিবেচ্য বিষয় এই  কর্মের উদ্দেশ্য কি আমরা দেখিতে পাই,
প্রত্যেক দেশের অধিকাংশ লােকের এই বিশ্বাস যে, এক সময়ে এই জগৎ পূর্ণতা লাভ করিবে ; তখন ব্যাধি মৃত্যু দুঃখ বা দুর্নীতি থাকিবে না।(  অনাসক্তি পূর্ণ আত্মত্যাগ )  ইহা খুব
ভাল ভাব, অজ্ঞ ব্যক্তিদের উন্নত ও উৎসাহিত করিতে ইহা খুবই প্রেরণা এরূপ কখনাে হইতে পারে না। কিরূপে ইহা হইতে পারে ভাল-মন্দ যে যােগায়, কিন্তু যদি আমরা এক মুহূর্ত চিন্তা করি, তাহা হইলে স্পষ্টই দেখিব,
একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। মন্দকে ছাড়িয়া ভাল কিরূপে পাওয়া যায় পূর্ণতার অর্থ কি 'পরিপূর্ণ জীবন একটি স্ব-বিরােধী বাক্য। প্রত্যেকটি বাহিরের বস্তুর
সহিত আমাদের নিয়ত সংগ্রামের অবস্থাই জীবন। প্রতি মুহূর্তে আমরা আমাদের জীবন ধ্বংস হইয়া যাইবে। আহার ও বায়ুর জন্য প্রতিনিয়ত
বহিঃপ্রকৃতির সহিত সংগ্রাম করিতেছি, যদি আমরা ইহাতে পরাস্ত হই , চেষ্টা এই তাে জীবন! আহার বা বায়ু না পাইলেই আমাদের মৃত্যু। জীবন একটা সহজ ও স্বচ্ছন্দ ব্যাপার নয়, উহা রীতিমত একটি জটিল ব্যাপার। এই বহির্জগৎ ও অন্তর্জগতের মধ্যে যে জটিল সংগ্রাম, তাহাকেই আমরা জীবন বলি। অতএব স্পষ্টই দেখা যাইতেছে এই সংগ্রাম শেষ হইলে জীবনও শেষ
হইবে। আদর্শ সুখ বলিতে বুঝায় এই সংগ্রামের সমাপ্তি। কিন্তু তাহা হইলে। জীবনও শেষ হইবে, কারণ সংগ্রাম তখনই শেষ হইতে পারে যখন জীবনের
শেষ। এই অবস্থার সহস্র ভাগের এক ভাগ উপস্থিত হইবার পূর্বেই এ পৃথিবী শীতল হইয়া যাইবে, তখন আমরা থাকিব না। অতএব অন্যত্র হয় হউক, এই
পৃথিবীতে এই সত্যযুগ এই আর্দশ যুগ কখনই আসিতে পারে না। আমরা পূর্বেই দেখিয়াছি, জগতের উপকার করিতে গিয়া প্রকৃত পক্ষে আমরা নিজেদেরই উপকার করিয়া থাকি। অপরের জন্য আমরা যে কার্য করি , তাহার মুখ্য ফল আমাদের চিত্তশুদ্ধি। সর্বদা অপরের কল্যাণচেষ্টা করিতে গিয়া আমরা নিজেদের ভুলিবার চেষ্টা করিতেছি। এই আত্মবিস্মৃতিই আমাদের
জীবনে এক প্রধান শিক্ষার বিষয়। মানুষ মূখের মতাে মনে করে স্বার্থপর উপায়ে সে নিজেকে সুখী করিতে পারে। বহুকাল (চেষ্টার পর সে অবশেষে
বুঝিতে পারে, প্রকৃত সুখ স্বার্থপরতার নাশে, এবং সে নিজে ব্যতীত অপর কেহই তাহাকে সুখী করিতে পারে না। পরােপকার-মুলক প্রতিটি কার্য, সহানুভূতিসূচক প্রতিটি চিন্তা, অপরকে আমরা যেটুকু সাহায্য করি—এরূপ প্রত্যেকটি সকার্য আমাদের ক্ষুদ্র‘ আমি’র গরিমা কমাইতেছে এবং আমাদের ভাবিতে শিখাইতেছে, আমরা অতি সামান্য, সুতরাং এগুলি সৎকার্য। এইখানে দেখি, জ্ঞান ভক্তি ও কর্ম একটি ভাবে মিলিত হইয়াছে। সর্বোচ্চ আদর্শ—অনন্তকালের জন্য পূর্ণ আত্মত্যাগ, যেখানে কোন ‘আমি’ নাই, সব ‘তুমি'। জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে কর্মযােগ মানুষকে ঐ লক্ষ্যেই লইয়া যায়।
একজন ধর্মপ্রচারক নিগুণ (ব্যক্তিভাবশূন্য) ঈশ্বরের কথা শুনিয়া ভয় পাইতে পারেন। তিনি সগুণ ঈশ্বরের উপর জোর দিতে পারেন, নিজের নিজত্ব ও ব্যক্তিত্ব এগুলির তাৎপর্য তিনি যাহাই বুঝন অক্ষুন্ন রাখিবার
ইচ্ছা করিতে পারেন, কিন্তু তিনি যে নৈতিক আদর্শ অবলম্বন করিয়াছেন , ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে না। ইহাই সমুদয় নীতির ভিত্তি। এই
তাহা যদি যথার্থই ভাল হয়, তবে উহা সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ ব্যতীত আর কোন ভাবটি মনুষ্যে পশুতে বা দেবতায় সর্বত্র সমভাবে একমাত্র মাপকাঠি' রূপে
প্রয়ােগ করিতে পার। এই আত্মত্যাগই সমুদয় নীতি প্রণালীর মধ্যে অনুস্যত একমাত্র মূল তত্ত্ব ইহাই প্রধান ভাব। এ জগতে অনেক প্রকারের মানুষ দেখিতে পাইবে। প্রথমতঃ দেশপ্রকৃতি
মানব ইহারা পূর্ণ আত্মত্যাগী, নিজেদের প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করিয়া পরের উপকার করেন। ইহারাই শ্রেষ্ঠ মানুষ। যদি কোন দেশে এইরূপ একশত মানুষ থাকেন, সেই দেশের কখনাে হতাশ হইবার কোন কারণ নাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁহাদের সংখ্যা খুব কম। তারপর আছেন সৎ বা সাধু ব্যক্তিগণ যতক্ষণ নিজেদের কোন ক্ষতি না হয়, ততক্ষণ ইহাৱা লােকের
উপকার করেন তারপর তৃতীয় শ্রেণীর লােক ইহারা নিজেদের হিতের । জন্য অপরের অনিষ্ট করিয়া থাকে। একজন সংস্কৃত কৰি বলিয়াছেন, আর
এক চতুর্থ শ্রেণীর মানুষ আছে, তাহারা অনিষ্টের জন্যই অনিষ্ট করিয়া থাকে। সর্বোচ্চ স্তরে যেমন দেখা যায়, সাধু-মহাত্মার ভালর জন্যই ভাল করিয়া
থাকেন, তেমনি সর্বনিম্ন প্রান্তে এমন কতকগুলি লােক আছে, যাহারা কেবল। অনিষ্টের জন্যই অনিষ্ট করিয়া থাকে। তাহারা উহা হইতে কিছু লাভ করিতে
পারে না, কিন্তু ঐ অনিষ্ট করাই তাহাদের স্বভাব।
দুইটি সংস্কৃত শব্দ আছে  একটি—প্রবৃত্তি', সেইদিকে আবর্তিত হওয়া অর্থাৎ যাওয়া। আর একটি নিবৃত্তি’, সেইদিক হইতে নিবৃত্ত হওয়া অর্থাৎ ফিরিয়া আসা। সেইদিকে বর্তিত হওয়াকে সংসার বলি। এই ‘আমি আমার আঁকড়াইয়া ধরা। সর্বদাই সব জিনিস এই ‘আমি’-রূপ কেন্দ্রে জড়াে করা । করিতেছে এইগুলি সব প্রবৃত্তির অন্তর্ভূত। এই প্রবৃত্তির প্রকৃতি সব কিছু
যাহা কিছু এই ‘আমি’কে টাকা-কড়ি, ক্ষমতা, নাম-যশ দ্বারা সর্বদাই সমৃদ্ধ ইহাই প্রবৃত্তি ইহাই মনুষ্যমাত্রের স্বাভাবিক প্রবণতা, চারিদিক হইতে যাহা।
কিছু সব গ্রহণ করা এবং এক কেন্দ্রের চারিদিকে জড়াে করা। সেই কেন্দ্রে তাহার নিজের মধুর ‘আমি’ । যখন এই প্রবণতা ভাঙিতে থাকে, যখন নিবৃত্তি
বা ‘সেদিক হইতে চলিয়া যাওয়ার ভাব আসে, তখনই নীতি এবং ধর্ম আরও হয়। প্রবৃত্তি’ ও ‘নিবৃত্তি' উভয়ই কর্ম ; প্রথমটি অসৎ কর্ম, দ্বিতীয়টি সৎ কর্ম
‘আত্মত্যাগ–পরের জন্য মন, শরীর, এমন কি সর্বস্ব ত্যাগ করিতে সর্বদা । এই নিবৃত্তিই সকল নীতি এবং ধর্মের মূল ভিত্তি। উহার পূর্ণতাই সম্পূর্ণ
প্রস্তুত থাকা। যখন এই অবস্থা লাভ হয়, তখনই মানুষ কর্মযােগে সিদ্ধি লাভ করে। সৎকর্মের ইহাই শ্রেষ্ঠ ফল। এক ব্যক্তি সমগ্র জীবনে একটি দশনশাস্ত্রও পাঠ করেন নাই, তিনি হয়তাে কখনাে কোনরূপ ঈশ্বরে বিশ্বাস
করেন নাই, এবং এখনাে করেন না, তিনি হয়তাে সারা জীবনে একবারও ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করেন নাই; কিন্তু যদি কেবল সৎ কর্মের শক্তি তাহাকে
এমন অবস্থায় লইয়া যায়, যেখানে তিনি পরার্থে তাহার জীবন ও যাহা কিছু সব ত্যাগ করিতে উদ্যত হন, তাহা হইলে বুঝিতে হইবে, জ্ঞানী জ্ঞানের দ্বারা
এবং ভক্ত উপাসনা দ্বারা যে অবস্থায় উপনীত হইয়াছেন, তিনিও সেইখানেই
পেীছিয়াছেন। সুতরাং দেখি ওয়ানী, কর্মী ও ভক্ত সকলে একই স্থানে উপনীত হইলেন, মিলিত হইলেন। এই একস্থান আত্মত্যাগ। মানুষে মানুষে
দার্শনিক মত ও ধর্মবিষয়ক পদ্ধতি যতই ভিন্ন হউক না কেন, পরার্থে আত্মা-বিসৰ্জন করিতে প্রস্তুত ব্যক্তির সমক্ষে সমগ্র মানবজাতি সসম্রমে ও
ভক্তিসহকারে দণ্ডায়মান হয়। এখানে কোনপ্রকার মতবিশ্বাসের প্রশ্নই উঠে না এমন কি যাহারা সর্বপ্রকার ধর্মভাবের বিরােধী, তাহারাও যখন এইরূপ
সম্পূর্ণ আত্ম-বিসর্জনের কোন কাজ দেখে তখন অনুভব করে, এ কাজকে শ্রদ্ধা করিতেই হইবে। তােমরা কি দেখ নাই, খুব গোড়া খ্রীস্টানও যখন
এডুইন আর্নল্ডের 'এশিয়ার আলােক' (Light of Asia) পাঠ করেন, তখন নাই, আত্মত্যাগ ব্যতীত আর কিছুই প্রচার করেন নাই ধর্মান্ধ ব্যক্তি শুধু
তিনিও বুদ্ধের প্রতি কেমন শ্রদ্ধাসম্পন্ন হন যে বুদ্ধ ঈশ্বরের কথা বলেন জানে না যে, তাহার ও যাহাদের সহিত তাহার মতবিরােধ, তাহাদের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একই। উপাসক ভক্ত মনে সর্বদা ঈশ্বরের ভাব এবং চারিদিকে শুভ পরিবেশ রক্ষা করিয়া অবশেষে সেই একই স্থানে উপনীত হন। এবং বলেন “তােমার ইচ্ছা পূর্ণ হউক। তিনি নিজের জন্য কিছুই রাখেন
না। ইহাই আত্মত্যাগদার্শনিক জ্ঞানী ওয়ানের দ্বারা দেখেন এই আপাতপ্রতীয়মান 'আমি' ভ্রমমাত্র, এবং সহজে উহা পরিত্যাগ করেন। ইহাও প্রাচীনকালের বড় বড় ধর্মপ্রচারকগণ যে শিখাইয়াছেন 'ভগবান
সেই আত্মত্যাগ। অতএব কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান এখানে মিলিত হইল , নন--তাহার মর্মও এই আত্মত্যাগ। জগৎ এক জিনিস, ভগবান আর এক
জিনিস এই পার্থক্য অতি সত্য। জগৎ অর্থে তাহারা স্বার্থপরতাকেই লক্ষ্য করিয়াছেন। নিঃস্বার্থতাই ঈশ্বর। এক ব্যক্তি স্বর্ণময় প্রাসাদে সিংহাসনে উপবিষ্ট
থাকিয়াও সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থপর হইতে পারেন। তাহা হইলেই তিনি ঈশ্বর ভাবে মগ্ন। আর একজন হয়তাে কুটিরে বাস করে ছিল৷ অনাসক্তি পূর্ণ আত্মত্যাগ  বসন পরে এবং সংসারে।।

Life history more...



.............................Life History.......................   

No comments:

Powered by Blogger.