অনাসক্তিই পূর্ণ আত্মত্যাগ : Swami Vivekananda : বাণী ও রচনা : দ্বিতীয় পর্ব : Life History

অনাসক্তিই পূর্ণ আত্মত্যাগ : Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History 
অনাসক্তিই পূর্ণ আত্মত্যাগ : Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History

তাহার কিছুই নাই; তথাপি সে যদি স্বার্থপর হয়, তবে সে প্রচণ্ডভাবে সংসারে মগ্ন। এখন আমাদের মূলসূত্রগুলির পুনরাবৃত্তি করা যাক। আমরা বলি, ভালো করিতে গেলেই কিছু মন্দ এবং মন্দ করিতে গেলেই তার সঙ্গে কিছু ভাল না করিয়া থাকিতে পারি না। ইহা জানিয়া, আমরা কর্ম করিব কিরূপে? এই তত্ত্বের মীমাংসার চেষ্টায় এই জগতে অনেক সম্প্রদায়ের অভূদয় হইয়াছিল,যাহারা অত্যন্ত অযৌক্তিকভাবে প্রচার করিয়া গিয়াছেন যে, ধীরে ধীরে আত্মহত্যা করাই সংসার হইতে মুক্ত হইবার একমাত্র উপায় ; কারণ জীবন-ধারণ করিতে গেলেই মানুষকে ছােট ছােট জীবজন্তুর ও বৃক্ষলতার সুতরাং তাহাদের মতে সংসারচক্র হইতে বাহির হইবার একমাত্র উপায় জীবন নষ্ট করিতে হইবে, অথবা কাহারও না কাহারও অনিষ্ট করিতে হইবে মৃত্যু। এই মতবাদকে জৈনগণ তাহাদের সর্বোচ্চ আদর্শ বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। আপাততঃ এই উপদেশ খুব যুক্তিসঙ্গত বলিয়া বােধ হয়। কিন্তু গীতাতেই ইহার প্রকৃত সমাধান পাওয়া যায় ইহাই অনাসক্তির তত্ত্ব, জীবনে কাজ করি কিছুতেই আসক্ত না হওয়া। জানিয়া রাখ যদিও তুমি জগতে রহিয়াছ, তুমি জগৎ হইতে সম্পূর্ণ পৃথক; যাহাই কর না কেন, তাহা নিজের জন্য করিতেছ না। নিজের জন্য যে কাজ করিবে, তাহার ফল তােমাকে ভােগ করিতে হইবে। কার্য যদি সৎ হয়, তােমাকে উহার শুভ ফল ভােগ করিতে হইবে, অসৎ হইলে উহার অশুভ ফল ভােগ করিতে হইবে। কিন্তু । যে-কোন কার্যই হউক, তাহা যদি তােমার নিজের জন্য কৃত না হয়, তাহা হইলে উহা তোমার উপর কোন প্রভাব বিস্তার করিতে পারিবে না। আমাদের
শাস্ত্রে এই ভাবব্যঞ্জক একটি বাক্য পাওয়া যায় “যদি কাহারও জ্ঞান থাকে, যেআমি ইহা নিজের জন্য করিতেছি না, তবে তিনি সমগ্র জগৎকে হত্যা
করিয়াও বা নিজে হত হইয়াও হত্যা করেন না, বা হত হন না। এইজন্যই কর্মযােগ আমাদিগকে বিশেষভাবে শিক্ষা দেয়, ‘সংসার ত্যাগ করিও না ; সংসারে বাস কর, সংসারের ভাব যত ইচ্ছা গ্রহণ কর; কিন্তু নিজের
সুখভােগের জন্য কাজ একেবারেই করিও না।' ভােগ যেন লক্ষ্য না হয়। প্রথমে নিজের ক্ষুদ্র ‘আমি’কে মারিয়া ফেল, তারপর সমুদয় জগৎকে
আপনার করিয়া দেখ, যেমন প্রাচীন খ্রীস্টানেরা বলিতেন, 'পুরাতন মানুষটিকে মারিয়া ফেলিতে হইবে। পুরাতন মানুষ' শব্দের অর্থঃ জগৎ আমাদের
ভােগের জন্য নির্মিত হইয়াছে—এই স্বার্থপর ভাৰ। অজ্ঞ পিতামাতারা তাহাদের সন্তানদিগকে প্রার্থনা করিতে শেখান, 'হে প্রভাে, তুমি এই সূর্য চন্দ্র
আমার জন্য সৃষ্টি করিয়াছ।' প্রভুর যেন এই সব শিশুর জন্য যাবতীয় পদার্থ সৃষ্টি করা ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না। ইহা শুধু আমাদের কামনারূপ
অগ্নিতে ঘৃত নিক্ষেপ করা। সন্তানদিগকে এমন বাজে কথা শিখাইও না। তারপর একদল লােক আছেন, তাহারা আবার আর এক ধরনের নির্বোধ।
তাহারা আমাদিগকে শিক্ষা দেন, আমরা মারিয়া খাইব বলিয়াই এই সকল জীবজন্তু সৃষ্ট হইয়াছে, আর এই জগৎ মানুষের ভােগের জন্য। এও প্রচণ্ড
নির্বুদ্ধিতা। বাঘও বলিতে পারে, মানুষ আমার জন্য সৃষ্ট এবং ভগবানকে বলিতে পারে, 'প্রভাে, মানুষগুলি কি দুষ্ট! তাহারা স্বেচ্ছায় আমাদের সম্মুখে
আহাররূপে আসিয়া হাজির হয় না, তাহারা তােমার আজ্ঞা লঙ্ঘন করিতেছে।' যদি জগৎ আমাদের জন্য সৃষ্ট হইয়া থাকে, আমরাও জগতের জন্য সৃষ্ট হইয়াছি। এই জগৎ আমাদের ভােগের জন্যই সৃষ্ট হইয়াছে—এই
অতি দুর্নীতিপূর্ণ ধারণাই আমাদিগকে বাধিয়া রাখিয়াছে। এই জগৎ আমাদের জন্য নয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতি বৎসর ইহজগৎ হইতে চলিয়া যাইতেছে,
জগতের খেয়ালই নাই। আর লক্ষ লক্ষ মানুষ তাহাদের স্থান পূরণ করিতেছে। জগৎ যতখানি আমাদের জন্য, আমরাও ততখানি জগতের জন্য।
অতএব ঠিকভাবে কাজ করিতে হইলে প্রথমেই আসক্তির ভাব ত্যাগ করিতে হইবে। দ্বিতীয়তঃ হৈচৈপূর্ণ কলহে নিজেকে জড়াইও না; নিজে
সাক্ষী-স্বরূপ অবস্থিত থাকিয়া কর্ম করিয়া যাও। আমার গুরুদেব বলিতেন,“নিজ সন্তানদের উপর দাসী বা ধাত্রীর ভাব অবলম্বন কর।' দাসী তােমার
শিশুকে লইয়া আদর করিবে, তাহার সহিত খেলা করিবে, অতি যত্নের সহিত লালন করিবে, যেন তাহার নিজের সন্তান; কিন্তু দাসীকে বিদায় দিবামাত্র সে
গটরি বাধিয়া তােমার বাড়ি হইতে চলিয়া যাইতে প্রস্তুত। এত যে ভালবাসা ও আসক্তি, সবই সে ভুলিয়া যায়। সাধারণ দাসীর পক্ষে তােমার সন্তানদের।
ছাড়িয়া অপরের ছেলের ভার লইতে কিছুমাত্র কষ্ট হইবে না। তুমিও যাহা কিছু তােমার নিজের মনে কর, সে-সবের প্রতি এইরূপ ভাব পােষণ কর।
তুমি যেন দাসী, আর যদি ঈশ্বরে বিশ্বাসী হও, তবে বিশ্বাস কর, যাহা কিছু তােমার মনে কর, সবই তাহার। অত্যধিক দুর্বলতাই অনেক সময় মহত্তম কল্যাণ ও শক্তির ছদ্মবেশে দেখা দেয়। আমার উপর কেহ নির্ভর করে এবং আমি কাহারও উপকার করিতে পারি, এরূপ চিন্তা করাই অত্যন্ত দুর্বলতা। এই বিশ্বাস হইতেই আমাদের সর্বপ্রকার আসক্তি জন্মায় এবং এই আসক্তি হইতেই সকল দুঃখের উদ্ভব। আমাদের মনকে জানানাে উচিত যে, এই বিশ্বজগতে কেহ আমাদের উপর নির্ভর করে না, একজন গরিবও আমাদের দানের উপর নির্ভর করে না, কেহই আমাদের দয়ার উপর নির্ভর করে না, একটি প্রাণও আমাদের সাহায্যের উপর নির্ভর করে না। প্রকৃতিই সকলকে সাহায্য করিতেছে। আমরা কোটি কোটি মানুষ না থাকিলেও এইরূপ সাহায্য চলিবে।
তােমার আমার জন্য প্রকৃতির গতি বন্ধ থাকিবে না। পুর্বেই বলা হইয়াছে , অপরকে সাহায্য করিয়া আমরা নিজেরাই শিক্ষা লাভ করিতেছি, ইহাই
শিখিতে হইবে। যখন আমরা সম্পূর্ণরূপে ইহা শিক্ষা করিতে পারি, তখন তােমার ও আমার পরম সৌভাগ্য। সমগ্র জীবনে এই এক মহৎ শিক্ষাই
আর আমাদের দুঃখ থাকিবে না, তখন আমরা সমাজে যেখানে খুশি সেখানে গিয়া মিশিতে পারি, কোন ক্ষতি হইবে না। তােমাদের পতি-পত্নী, দাস-দাসী,
রাজ্য এ সব থাকিতে পারে, কিন্তু যদি তুমি এই তত্ত্বটি হৃদয়ে রাখিয়া কাজ কর যে, জগৎ তােমার ভােগের জন্য নয়, আর তুমি সাহায্য না করিলে চলিবে না এমনও নয়, তবেই ঐসকল বস্তু তােমাদের কোন ক্ষতি করিতে জগৎ কি স্বীয় গতি রুদ্ধ করিয়া তাহাদের পুনরাগমনের জন্য অপেক্ষা পারিবে না। এই বৎসরই হয়তাে তােমার কয়েকজন বন্ধু মারা গিয়াছেন।
করিতেছে? ইহার স্রোত কি বন্ধ হইয়া আছে না ইহা ঠিকই চলিয়া যাইতেছে। অতএব তােমার মন হইতে এই ভাব একেবারে দূর করিয়া দাও, যে তােমাকে জগতের জন্য কিছু করিতে হইবে। জগৎ তােমার নিকট হইতে
কোন সাহায্যই চায় না। জগতের সাহায্যের জন্যই আমার জন্ম-এ-কথা চিন্তা করা কোন মানুষের পক্ষে নির্বুদ্ধিতা। উহা নিছক অহঙ্কার। উহা
স্বার্থপরতা ধর্মের। রূপ ধরিয়া প্রতারণা করিতেছে। তােমার অথবা অন্য কাহারও উপর জগৎ নির্ভর করে না এই ভাবটি উপলব্ধি করিবার জন্য
যখন তােমার রায় ও পেশীগুলিকে গঠিত করিবে, তখন কর্মজনিত কোন প্রতিক্রিয়া তােমাকে পীড়িত করিবে না। যখন তুমি কোন লােককে কিছু দাও
এবং পরিবর্তে কিছুই আশা না কর, সে তােমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকুক এটুকু ওনা চাও, তখন তাহার অকৃতজ্ঞতা তােমার উপর কোন প্রতিক্রিয়া করিবে না,
কারণ তুমি কিছুই প্রত্যাশা কর নাই, কখনই চিন্তা কর নাই যে, তােমার প্রতিদান পাইবার কোন অধিকার আছে। তার যাহা প্রাপ্য ছিল, তুমি তাহাই
দিয়াছিলে। তাহার নিজ কর্মের ফলেই সে উহা পাইয়াছে, তােমার কর্ম তােমাকে উহার বাহক করিয়াছিল মাত্র। কিছু দান করিয়া তুমি গর্ববােধ
করিবে কেন—তুমি তাে উহার বাহক মাত্র জগৎ নিজ কর্মের দ্বারা উহা লাভ করিবার যােগ্য হইয়াছিল। ইহাতে তােমার অহঙ্কারের কারণ কি
জগৎকে তুমি যাহা দিতেছ, তাহা এমন একটা কিছু বড় নয়। অনাসক্তির ভাব লাভ করিলে তােমার পক্ষে আর ভাল বা মন্দ বলিয়া কিছুই থাকিবে না। স্বার্থই কেবল ভাল-মন্দের প্রভেদ করিয়া থাকে। এইটি বুঝা বড় কঠিন, কিন্তু সময়ে বুঝিবে যতক্ষণ না তুমি শক্তি প্রয়ােগ করিতে দাও, ততক্ষণ জগতের
কোন কিছুই তােমার উপর প্রভাব বিস্তার করিতে পারে না। যতক্ষণ না আত্মা অজ্ঞের মতাে হইয়া স্বীয় স্বতন্ত্রতা হারায়, ততক্ষণ কোন শক্তিই আম্মার উপর
প্রভাব বিস্তার করিতে পারে না ; অতএব অনাসক্তির দ্বারা তুমি তােমার উপর কোন কিছুর প্রভাব জয় কর অস্বীকার করে। কোন জিনিসের তােমার উপর
কিছু করিবার অধিকার নাই এ কথা বলা খুব সহজ; কিন্তু যিনি বাস্তবিকই কোন শক্তিকে তাহার উপর কাজ করিতে দেন না, বহির্জগৎ যাহার উপর
কাজ করিলে যিনি সুখীও হন না, দুঃখিতও হন না—সেই ব্যক্তির প্রকৃত লক্ষণ কি লক্ষণ এই যে, সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য কিছুই তাহার মনে কোন
পরিবর্তন সাধন করিতে পারে না; সকল অবস্থাতেই তিনি সমভাবে থাকেন। ভারতে ব্যাস নামক এক মহর্ষি ছিলেন। তিনি বেদান্ত-সূত্রের লেখক রূপে করিয়াছিলেন, কিন্তু পারেন নাই; তাহার পিতামহও চেষ্টা করিয়াছিলেন, পরিচিত, তিনি খুব ধার্মিক ছিলেন। তাঁহার পিতা সিদ্ধ হইবার চেষ্টা হন। তিনি নিজে সম্পূর্ণরূপে কৃতকার্য হইতে পারেন নাই, কিন্তু তাহার পুত্র তিনিও পারেন নাই; এইরূপে তাহার প্রপিতামহও চেষ্টা করিয়া অকৃতকার্য শুকদেব সিদ্ধ হইয়া জন্মগ্রহণ করিলেন। ব্যাস সেই পুত্রকে ওয়ানের উপদেশ
দিতে লাগিলেন। নিজে তত্ত্বজ্ঞান দিয়া তিনি শুকদেবকে জনকরাজার সভায় প্রেরণ করিলেন। তিনি একজন বড় রাজা ছিলেন এবং বিদেহ জনক' নামে
অভিহিত হইতেন; ‘বিদেহ’ শব্দের অর্থ দেহজ্ঞানশূন্য’, যদিও তিনি একজন। রাজা, তথাপি তিনি দেহবােধ সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হইয়াছিলেন। তিনি নিজেকে
সর্বদা 'আত্মা' বলিয়াই অনুভব করিতেন।
বালক শুককে শিক্ষার জন্য তাহার নিকট পাঠানাে হইল। রাজা জানিতেন, যে ব্যাসের পুত্র তাঁহার নিকট তত্ত্বজ্ঞান শিক্ষা করিবার জন্য আসিতেছেন,
সুতরাং তিনি পূর্ব হইতেই কতকগুলি ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। যখন এই বালক গিয়া রাজপ্রাসাদের দ্বারদেশে উপস্থিত হইলেন, তখন প্রহরিগণ তাহার কোন
খবরই লইল না। তাহারা কেবল তাহাকে বসিবার জন্য একটি আসন দিল। সেখানে তিনি তিন দিন তিন রাত্রি বসিয়া রহিলেন, কেহ তাহার সঙ্গে কথাই কহিতেছে না; তিনি কে, কোথা হইতে আসিয়াছেন—কেহই কিছু জিজ্ঞাসা করিল না। তিনি এত বড় একজন ঋষির পুত্র, তাহার পিতা সমগ্র দেশে সম্মানিত, তিনি নিজেও একজন মাননীয় ব্যক্তি, তথাপি সামান্য প্রহরিগণও
তাঁহার দিকে সুক্ষেপ করিতেছে না। অতঃপর সহসা রাজার মন্ত্রিগণ এবং বড়। বড় কর্মচারীরা আসিয়া তাহাকে অতিশয় সম্মানের সহিত অভ্যর্থনা করিলেন।
তাহারা তাহাকে ভিতরে এক সুশােভিত গৃহে লইয়া গেলেন, সুগন্ধি জলে স্নান করাইলেন, খুব ভাল ভাল পােশাক পরিতে দিলেন, আট দিন ধরিয়া তাহাকে সর্বপ্রকার বিলাসের ভিতর রাখিয়া দিলেন। কিন্তু এই ব্যবহারের পরিবর্তনে শুকের শান্ত গম্ভীর মুখে এতটুকু পরিবর্তন ঘটিল না। দ্বারে অপেক্ষা করিবার সময় তিনি যেরূপ ছিলেন, এই সকল বিলাসের মধ্যেও তিনি ঠিক সেইরূপই রহিলেন। তখন তাহাকে রাজার নিকট লইয়া যাওয়া হইল। রাজা সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলেন, নৃত্য-গীত-বাদ্য ও অন্যান্য আমােদ-প্রমােদ চলিতেছিল। রাজা তাহাকে কানায় কানায় পূর্ণ এক বাটি দুধ
দিয়া বলিলেন, “এই দুধের বাটিটি লইয়া সাতবার রাজসভা প্রদক্ষিণ করিয়া এস; সাবধান, যেন এক ফোটা দুধও না পড়ে। বালকও সেই বাটিটি লইয়া
এইসব গীত বাদ্য ও সুন্দরী রমণীগণের মধ্য দিয়া সাতবার সভা প্রদক্ষিণ করিলেন, এক ফোটা দুধও পড়িল না। সেই বালকের মনের উপর এমন
ক্ষমতা ছিল যে, যতক্ষণ না তিনি ইচ্ছা করিবেন, ততক্ষণ তাহার মন কিছু দ্বারাই আকৃষ্ট হইবে না। বালক সেই পাত্রটি রাজার নিকট লইয়া আসিলে রাজা তাহাকে বলিলেন, “তােমার পিতা তোমাকে যাহা শিখাইয়াছেন এবং তুমি নিজে যাহা শিখিয়াছ, আমি তাহারই পুনরাবৃত্তি করিতে পারি, তুমি সত্য।
উপলব্ধি করিয়াছ; এখন গৃহে গমন কর। অতএব দেখা গেল, যে ব্যক্তি নিজেকে বশীভূত করিয়াছে, বাহিরের কোন বস্তু তাহার উপর ক্রিয়া করিতে পারে না, তাহাকে আর কাহারও দাসত্ব করিতে হয় না। তাহার মন মুক্ত। এরূপ ব্যক্তিই জগতে সুখে-স্বচ্ছন্দে বাস
করিবার যােগ্য। আমরা সচরাচর দুই মতের মানুষ দেখিতে পাই। কেহ কেহ দুঃখবাদী—তাহারা বলেন, এ পৃথিবী কি ভয়ানক, কি অসৎ! অপর কতক গুলি ব্যক্তি সুখবাদী—তাহারা বলেন, এই জগৎ কি সুন্দর, কি অপূর্ব ! যাহারা নিজেদের মন জয় করেন নাই, তাহাদের পক্ষে এই জগৎ দুঃখে পূর্ণ , অথবা সুখ-দুঃখ-মিশ্রিত বলিয়া প্রতিভাত হয়। আমরা যখন আমাদের মনকে
বশীভূত করিতে পারিব, তখন এই সংসার আবার সুখের বলিয়া মনে হইবে। তখন কোন কিছুই আমাদের মনে ভাল বা মন্দ ভাব উৎপন্ন করিতে পারিবে।
না। আমরা সবই বেশ যথাস্থানে সামঞ্জস্যপূর্ণ দেখিতে পাইব। যাহারা প্রথমে সংসারকে নরককুণ্ড বলিয়া মনে করে, তাহারাই আত্মসংযমে সমর্থ হইলে এই
জগৎকে স্বর্গ বলিবে। আমরা যদি প্রকৃত কর্মযােগী হই এবং নিজদিগকে এই অবস্থায় লইয়া যাইবার জন্য শিক্ষিত করিতে ইচ্ছা করি, তবে আমরা যেখানেই আরম্ভ করি না কেন, পরিশেষে পূর্ণ আত্মত্যাগের অবস্থায় উপনীত হইবই; যখনই এই কল্পিত ‘অহং’ চলিয়া যায়, তখনই যে-জগৎ প্রথমে অমঙ্গলপূর্ণ বলিয়া মনে হয়, তাহা পরমানন্দে পূর্ণ এবং স্বর্গ বলিয়া বােধ
হইবে। ইহার হাওয়া পর্যন্ত শান্তিতে পূর্ণ হইয়া যাইবে, প্রত্যেক মানুষের মুখচ্ছবি ভাল বলিয়া বােধ হইবে। ইহাই কর্মযােগের চরম গতি ও উদ্দেশ্য , এবং ইহাই  পূর্ণতা বা সিদ্ধি। অতএব দেখিতেছ, এই ভিন্ন ভিন্ন যােগ পরস্পর-বিরােধী নয়। প্রত্যেকটিই
আমাদিগকে একই লক্ষ্যে লইয়া যায়, পূর্ণ করিয়া দেয়। কিন্তু প্রত্যেকটিই দৃঢ়ভাবে অভ্যাস করিতে হইবে। অভ্যাসই সিদ্ধির সমগ্র রহস্য। প্রথমে শ্রবণ, তারপর মনন, তারপর অভ্যাস প্রত্যেক যােগ সম্বন্ধেই ইহা সত্য। প্রথমে পাারে  না, তাহা পুনঃপুনঃ শ্রবণ ও মননের ফলে স্পষ্ট হইয়া যাইবে। সব
শুনিতে হইবে, তারপর বুঝিতে হইবে; অনেক বিষয় যাহা একেবারে বুঝিতে। ভিতরে কেহই প্রকৃতপক্ষে কখনাে অপরের দ্বারা শিক্ষিত হয় নাই।
বিষয় শােনামাত্রই বুঝা বড় কঠিন। প্রত্যেক বিষয়ের ব্যাখ্যা তােমার নিজের উদ্দীপক কারণমাত্র। সেই উদ্দীপনা দ্বারা আমাদের ভিতরের আচাহি প্রত্যেককেই নিজে নিজে শিক্ষা লাভ করিতে হইবে বাহিরের আচার্য কেবল আমাদিগকে সকল বিষয় বুঝাইয়া দিবার জন্য উদ্বোধিত হন। তখন সব কিছুই আমাদের অনুভব ও চিন্তা দ্বারা প্রত্যক্ষ ও স্পষ্ট হইয়া আসে। তখন আমরা
নিজেদের আত্মার ভিতরে ঐ-সকল তত্ত্ব অনুভব করিব এবং এই অনুভূতিই প্রবল ইচ্ছাশক্তিরূপে পরিণত হইবে। প্রথমে ভাব তারপর ইচ্ছা। এই ইচ্ছা
হইতে এমন প্রবল কর্মের শক্তি আসিবে যে, তাহা প্রতি শিরায়, প্রতি স্নায়ুতে , প্রতি পেশীতে ক্রিয়া করিতে থাকিবে যতক্ষণ না তােমার সমুদয় শরীরটি
এই নিষ্কাম কর্মযােগের একটি যন্ত্রে পরিণত হয়। ইহার ফল সম্পূর্ণ আত্মত্যাগপূর্ণ নিঃস্বার্থতা। ইহা কোন মতামত বা বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে না। খ্রীস্টানই হও, ইহুদিই হও আর জেণ্টাইলই হও, তাহাতে কিছু
আসে যায় না ; একমাত্র জিজ্ঞাস্য তুমি কি স্বার্থশূন্য? যদি তাই হও, তবে তুমি একখানি ধর্মপুস্তকও না পড়িয়া এবং কোন গির্জায় বা মন্দিরে না গিয়াও
সিদ্ধ হইবে। আমাদের বিভিন্ন যােগপ্রণালীর প্রত্যেকটিই অপর প্রণালীর। কিছুমাত্র সহায়তা না লইয়া মানুষকে পূর্ণ করিতে সমর্থ; কারণ প্রত্যেকটিই
লক্ষ্য একই। কর্মযােগ, জ্ঞানযােগ, ভক্তিযােগ-সকল যােগই মুক্তিলাভের সাক্ষাৎ ও অন্য নিরপেক্ষ উপায়। সাংখ্যযােগে পৃথলাঃ প্ৰদন্তি পণ্ডিতাঃ১ অজ্ঞেরাই কর্ম জ্ঞানকে পৃথক বলিয়া থাকে, পণ্ডিতেরা নয়।
জ্ঞানীরা জানেন আপাততঃ পৃথক বলিয়া প্রতীয়মান হইলেও শেষ পর্যন্ত ঐ দুই পথ মানুষকে পূর্ণতারূপে একই লক্ষ্যে পৌছাইয়া দেয়।

Life history more.... 



..........................Life History..........................   

No comments:

Powered by Blogger.