নিজ নিজ কর্মক্ষ্রেত্রে প্রতেকেই বড় : Swami Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History

 নিজ নিজ কর্মক্ষ্রেত্রে  প্রতেকেই বড় : Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History  

নিজ নিজ কর্মক্ষ্রেত্রে  প্রতেকেই বড় : Swami  Vivekananda : বাণী ও রচনা : Life History

Swami vivekananda 


নিজ নিজ কর্মক্ষ্রেত্রে  প্রতেকেই বড় 

প্রত্যেক ব্যাক্তির ভিতরেই এই শত্তি রহিয়াছে । কখনো তমঃ প্রবল হইয়া উঠে - আমারা আলস্য পরায়ণ হই,
আমারা যেন আর নড়িতে পারি না, নিস্কর্মা হইয়া যাই,
কতগুলি ভাবের অথবা শুধু জড়তার বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া পড়ি। আবার কখনো কখনো কর্মশীলতা প্রবল
হয়। অন্য সময়ে আবার  উভয় ভাবের সাম্য বিরাজ করে, মনে শান্ত   ভাব আসে। আবার ভিন্ন ভিন্ন  ব্যাক্তিতে সচরাচর এই উপাদান - ত্রয়ের কোন একটির
প্রধান্য দেখা যায়। একজন হয়তো কর্মশূন্যতা, শত্তি,
মহাশত্তির বিকাশ ; আবার কাহারও ভিতর আমরা শান্ত
মৃদুমধুর ভাব দেখিতে পাই, ইহা ঐ পূর্বোক্ত গুনদ্বয়ের
মানে ক্রিয়াশীলতা ও নিস্ক্রিয়তার  সমান। এইরূপে
সমুদয় সৃষ্ট জগতে পশু ও মানুষ ও উদ্ভিদ সকলের মধ্যেই আমরা এই বিভিন্ন শক্তির কম - বেশি   প্রকাশ
পাই। এই ত্রিবিধ গুন বা উপাদনই বিষেশ কর্মযোগের
আলোচ্য বিষয়।নিজ নিজ কর্মক্ষ্রেত্রে  প্রতেকেই বড় 
 উহাদের স্বরূপ ও ব্যাবহারে কৌশল
শিখাইয়া  কর্মযোগ আমাদেরকে ভালোভাবে  কর্ম
করিতে সাহায্য  করে। মানব সমাজ একটি ক্রমনিবন্ধ
উহার অন্তগত ব্যাত্তিগণ সকলেই যেন এক এক 
 শ্রেণীতে ও বিভিন্ন সোপানে  অবস্থিত।

সুনীতি ও  কর্তব্য কাহাকে বলে?

নিজ নিজ কর্মক্ষ্রেত্রে  প্রতেকেই বড়  আমরা সকলেই জানি,  কিন্তুু দেখিতে পাই  - ভিন্ন ভিন্ন
দেশে এই নৈতিক ধারণা অত্যন্ত  বিভিন্ন। এক দেশে যাহা সুনীতি বলিয়া বিবেচিত হয়, দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখ কোন কোন দেশে ভাই ভাগীনীর মধ্যে বিবাহ সম্ভব,
অপর দেশে আবার উহা অতিশয় নীতি বিরুদ্ধ বলিয়া
বিবেচিত হয়,  অপর দেশে হয়তো তাহা নিষেধ বলিয়া
এইরূপেে আমরা সদাচারের অন্যান্য বিভাগেও দেখিতে
পাই যে, সদাচারের একটি সর্বভৌম মান ও আদর্শ আছে।আমাদের প্রথম কর্তব্য নিজেকে ঘৃণা না করা, উন্নত হইতে হইলে প্রথমে নিজের উপর, তার পর ইশ্বরের উপর বিশ্বাস আবশ্যক। যাহার নিজের উপর  বিশ্বাস নেই, তাহার কখনই  ইশ্বরে বিশ্বাস আসিতে পারেনা।
তোমরা অনেকেে ভগবদ্ গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় পাঠ করিয়া আশ্চর্য হইয়াছো,   বিপক্ষগণ   আত্বীয় ও
বন্ধুবান্ধব বলিয়া এবং অহিংসাই পরম ধর্ম,
এই অজুহাতে অর্জুন  যখন যুদ্ধ করিতে, প্রতিরোধ
করিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করিলেন, শ্রীকৃষ্ণ তখন তাঁহাকে
কাপুরুষ ও কপট বলিয়াছেন। এটি একটি প্রধান  শিক্ষণীয় বিষয় যে,  সকল ব্যাপারেই চরম বিপরীত
প্রান্ত- দুইটি দেখিতে একই প্রকার।
চূড়ান্ত- অস্তি - ও  চূড়ান্ত- নাস্তি  - সকল সময়েই সদৃশ।  আলোক - কম্পন যখন অতি মৃদু,  তখন উহা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়না ,  একজন কোন অন্যায়ের প্রতিকার
করে না,  কারণ সে দুর্বল অলস ও প্রতিকারে অক্ষম ;
প্রতিকারের ইচ্ছা নাই বলিয়া প্রতিবাদ করে না, তাহা নয়।  আর একজন জানে ইচ্ছা করিলে সে  আঘাত হানিতে পারে, তথাপি সে শুধু যে আঘাত করে না,  তাহা নয়,  বরং শত্রুকে আশীর্বাদ করে। যে ব্যাত্তি দুর্বলতাবশতঃ প্রতিকার করে না, সে পাপ করিতেছে
সুতরাং এই অপ্রতিকার হইতে সে কোন সুফল অর্জন
করিতে পারে না। পক্ষান্তরে অপর ব্যাক্তি যদি প্রতিকার
করে, তবে পাপ করিবে। বুদ্ধ নিজ সিংহাসন ও রাজপদ ত্যাগ করিলেন - ইহা প্রকৃত ত্যাগ বটে, কিন্তুু যাহার ত্যাগ করিবার কিছুই নাই,  এমন ভিক্ষুকের পক্ষে ত্যাগের কোন কথাই উঠিতে পারে না। অতএব এই
অপ্রতিকার, ও আদর্শ প্রেমের কথা বলিবার সময় আমরা প্রকৃত পক্ষে কি বুঝিতেছি, সেইদিকে বিষেষ ভাবে দৃষ্টি রাখিতে হইবে। আগে সযত্নে বুঝিবে হইবে,
প্রতিকার করিবার শত্তি আমাদের আছে কিনা। শত্তি
থাকা  সত্বেও যদি প্রতিকার চেষ্টা শূন্য হই, তবে আমরা
বাস্তবিক অপূর্ব  প্রেমের কাজ করিতেছে,  কিন্তুু যদি আমাদের প্রতিকারের শত্তি না থাকে, এবং নিজেদের
 মনকে বুঝাইবার চেষ্টা করি যে,  আমরা অতি উচ্চ প্রেমের প্রেরণায় কাজ করিতেছি,  তবে আমরা ঠিক
উহার বিপরীত আচরণই করিতেছি।   অর্জুন ও তাহার
বিপক্ষে প্রবল সৈন্যব্যূহ সজ্জিত দেখিয়া ভীত হইয়াছিলেন। স্নেহ বালোবাসা বশতঃ তিনি দেশের ও
রাজার প্রতি কর্তব্য ভুলিয়া গিয়াছিলেন।  এই জন্যই
শ্রীকৃষ্ণ তাহাকে কপট বলিতেছেন, কাপুরুষের মতো
কাজ করিতেছো,  ওঠ দাঁড়াও, যুদ্ধ কর।
ইহাই কর্মযোগের প্রধান ভাব। কর্মযোগী জানেন, অপ্রতিকারই সবোচ্চ আদর্শ, তিনি আরও জানেন যে
উহাই শক্তির উচ্চতম বিকাশ এবং অন্যায়ের প্রতিকার
কেবল অপ্রতিকার রূপ শত্তি লাভের সোপান মাত্র।
এই আদর্শে উপনীত হইবার পূর্বে মানুষের কর্তব্য ও
অশুভের প্রতিরোধ করা। কাজ করিতে হইবে, সংগ্রাম করিতে হইবে।  যতোদূর সাধ্য উদ্যম প্রকাশ করিয়া আঘাত করিতে হইবে। এই প্রতিকারের শত্তি যাঁহার আয়ত্ত হইয়াছে, তাঁহার পক্ষেই অপ্রতিকার ধর্ম বা পুণ্যকর্ম।
 আলস্য সর্বপ্রকারে ত্যাগ করিতে হইবে। ক্রিয়াশীলতা
সর্বদাই প্রতিরোধ বুঝাইয়া থাকে। মানসিক ও শারীরিক
সর্বপ্রকার অসদ্ ভাবের প্রতিরোধ কর,  যখন তুমি এই কাজে সফল হইবে, তখন শান্তি আসিবে। এ কথা বলা
অতি সহজ যে, কাহাকেও ঘৃণা করিও না, কিন্তু ইহার কি অর্থ দাঁড়ায়, তাহা আমরা জানি। যখন সমগ্র সমাজের চক্ষু আমাদের দিকে,  তখন আমরা অপ্রতিকারের ভাব দেখাইতে পারি,  কিন্তু বাসনা দিবারাত্রি দূষিত ক্ষতের ন্যায় আমাদের শরীর ক্ষয় করিতে থাকে।  অপ্রতিকার হইতে প্রাণে  যে শান্তি    ,
আমরা তাহার একান্ত অভাব অনুভব করি, মনে হয়
প্রতিকার করাই ভাল ছিল।
প্রত্যেকেরই কর্তব্য নিজ নিজ আদর্শ জীবনে পরিণত
করিতে চেষ্টা করা।
যথাসাধ্য চেষ্টা করুক। আমাকে তােমার বা তােমাকে আমার আকাশের কারা।
বিচার করা ঠিক নয়। ওক বৃক্ষের আদর্শে আপেলের অথবা আপেল বৃক্ষের আদর্শে ওকের বিচার করা উচিত নয়। আপেল বৃক্ষকে বিচার করিতে হইলে
আপেলের এবং ওক বৃক্ষকে বিচার করিতে হইলে ওকের আদর্শ লইয়াই বিচার করা আবশ্যক।
বহুত্বের মধ্যে একত্বই সৃষ্টির পরিকল্পিত নিয়ম। ব্যক্তিগতভাবে নরনারীর মধ্যে প্রভেদ যতই থাকুক না কেন, পশ্চাতে সেই একত্ব রহিয়াছে। বিভিন্ন চরিত্র এবং বিভিন্ন শ্রেণীর নরনারী সৃষ্টি-নিয়মের স্বাভাবিক বৈচিত্র্য মাত্র। এই কারণে একই আদর্শ দ্বারা সকলকে বিচার করা অথবা সকলের সম্মুখে একই।
আদর্শ স্থাপন করা উচিত নয়। এইরূপ কর্মপ্রণালী কেবল অস্বাভাবিক সংগ্রাম। সৃষ্টি করে। তাহার ফল এই দাড়ায় যে, মানুষ নিজেকে ঘৃণা করিতে আরম্ভ ।
করে এবং তাহার ধার্মিক ও সৎ হইবার পক্ষে বিশেষ বাধা উপস্থিত হয়। প্রত্যেক ব্যক্তিকে তাহার নিজের সর্বোচ্চ আদর্শ অনুসারে।
চলিবার চেষ্টায় উৎসাহিত করা এবং সঙ্গে সঙ্গে ঐ আদর্শ সত্যের যতটা নিকটবতী হয়, তাহার জন্যও চেষ্টা করা।আমরা দেখিতে পাই, অতি প্রাচীনকাল হইতেই হিন্দু ধর্মনীতিতে এই তত্ত্বটি স্বীকৃত হইয়াছে ; তাহাদের শাস্ত্রে ও ধর্মনীতি-বিষয়ক পুস্তকে ব্রহ্মচর্য,
গাহস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস—এই সকল বিভিন্ন আশ্রমের জন্য বিভিন্ন বিধির নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে।
হিন্দুশাস্ত্র মতে মানব-সাধারণের ধর্ম ব্যতীত প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে বিশেষ বিশেষ কর্তব্য আছে। হিন্দুকে প্রথমে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে ছাত্ররূপে জীবন
আরম্ভ করিতে হয়, তারপর বিবাহ করিয়া গৃহী হইতে হয় ; বৃদ্ধাবস্থায় হিন্দু গৃহস্থাশ্রম হইতে অবসর গ্রহণ করিয়া বানপ্রস্থ অবলম্বন করে এবং সর্বশেষে।
সংসার ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসী হয়। বিভিন্ন আশ্রম অনুসারে জীবনের প্রত্যেক স্তরে বিভিন্ন কর্তব্য উপদিষ্ট হইয়াছে। এই আশ্রমগুলির মধ্যে কোনটিই অপরটি হইতে বড় নয়। যিনি বিবাহ না করিয়া ধর্মকার্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন, তাহার জীবন যত মহৎ, বিবাহিত ব্যক্তির জীবনও তত মহৎ।
সিংহাসনে আরূঢ় রাজা যেরূপ মহান ও গৌরবান্বিত, রাস্তার ঐ ঝাড়দারও। সেইরূপ। রাজাকে তাহার রাজসিংহাসন হইতে উঠাইয়া ঝাড়দারের কাজ
করিতে দাও–দেখ তিনি কতটা পারেন। আবার ঝাড়দারকে লইযা খুব পছন্দ করি। যদি তােমরা বেদ পাঠ কর, দেখিবে—তাহাতে ‘অভয়
শব্দটি বার বার উক্ত হইয়াছে। কোন কিছুকেই ভয় করিও না—ভয় দুর্বলতার চিহ্ন। এই দুর্বলতাই মানুষকে ভগবানের পথ হইতে বিচ্যুত করিয়া নানা
পাপ-কর্মে টানিয়া লয়। সুতরাং জগতের ঘৃণা ও উপহাসের দিকে আদৌ লক্ষ্য না রাখিয়া অকুতােভয়ে নিজ কর্তব্য করিয়া যাইতে হইবে।যদি কেহ সংসার হইতে দূরে থাকিয়া ঈশ্বরের উপাসনা করিতে যান।
তাহার এরূপ ভাবা উচিত নয় যে, যাহারা সংসারে থাকিয়া জগতের হিতচেষ্টা।
করিতেছেন, তাহারা ঈশ্বরের উপাসনা করিতেছেন না। আবার যাহারা।
স্ত্রী-পুত্রাদির জন্য সংসারে রহিয়াছেন, তাহারা যেন সংসারত্যাগীদিগকে নীচ ভবঘুরে মনে না করেন।
তাই নিজ নিজ কর্মক্ষ্রেত্রে  প্রতেকেই বড় 
এই বিষয়টি আমি একটি গল্প দ্বারা বুঝাইব

নিজ নিজ কর্মক্ষ্রেত্রে  প্রতেকেই বড় 

কোন দেশে এক রাজা ছিলেন। তাহার রাজ্যে সমাগত সকল সাধু-সন্ন্যাসীকেই তিনি জিজ্ঞাসা করিতেন, “যে সংসার ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাস গ্রহণ করে সে বড়, না যে গৃহে থাকিয়া গৃহস্থের সমুদয় কর্তব্য করিয়া যায়
সে-ই বড় অনেক বিজ্ঞ লােক এই সমস্যা মীমাংসা করিবার চেষ্টাকরিলেন। কেহ কেহ বলিলেন, সন্ন্যাসী বড়।' রাজা এই বাক্যের প্রমাণ।
চাহিলেন। যখন তাহারা প্রমাণ দিতে অক্ষম হইলেন, তখন রাজা তাহাদিগকে । বিবাহ করিয়া গৃহস্থ হইবার আদেশ দিলেন। আবার অনেকে আসিয়া
বলিলেন, “স্বধর্মপরায়ণ গৃহস্থই বড়। রাজা তাহাদের নিকটও প্রমাণ।
চাহিলেন। যখন তাহারা প্রমাণ দিতে পারিলেন না, তখন তাহাদিগকেও তিনি গৃহস্থ করিয়া নিজ রাজ্যে বাস করাইলেন । অবশেষে আসিলেন এক যুবা সন্ন্যাসী ; রাজা তাহাকেও ঐরূপ প্রশ্ন। করাতে সন্ন্যাসী বলিলেন, “হে রাজ, নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রত্যেকেই বড়।
রাজা বলিলেন, 'এ-কথা প্রমাণ করুন।' সন্ন্যাসী বলিলেন, ‘হ, আমি প্রমাণ । করিব; তবে আসুন, কিছুদিন আপনাকে আমার মতাে থাকিতে হইবে, তবেই
যাহা বলিয়াছি, তাহা আপনার নিকট প্রমাণ করিতে পারিব। রাজা সম্মত হইলেন এবং সন্ন্যাসীর অনুগামী হইয়া রাজ্যের পর রাজ্য অতিক্রম করিয়া
আর এক বড় রাজ্যে উপস্থিত হইলেন। সেই রাজ্যের রাজধানীতে তখন এক মহাসমারােহ ব্যাপার চলিতেছিল। রাজা ও সন্ন্যাসী ঢাক ও অন্যান্য
নানাপ্রকার বাদ্যধ্বনি এবং ঘােষণাকারীদের চিৎকার শুনিতে পাইলেন। পথে পথে লোকেরা সুসজ্জিত হইয়া কাতারে কাতারে দাড়াইয়া আছে—আর টেড়া পেটা
হইতেছে। রাজা ও সন্ন্যাসী দাড়াইয়া দেখিতে লাগিলেন, ব্যাপারটা কি।
ঘােষণাকারী চিৎকার করিয়া বলিতেছিল, এই দেশের রাজকন্যা স্বয়ং বর সমাসীনা সুসজ্জিতা রাজকন্যাকে সভার চতুর্দিকে বহন করিয়া লইয়া যাওয়া।
হইত; তিনি সমবেত রাজপুত্রগণের এক একজনের দিকে তাকাইয়া । দেখিতেন, এবং কে কিরূপ গুণবান তাহা শুনিতেন। এইরূপ দেখিয়া ও শুনিয়া যদি সন্তুষ্ট না হইতেন, তিনি বাহকদিগকে বলিতেন, “আগাইয়া চল'
তখন সেই প্রত্যাখ্যাত পাণিপ্রার্থীদের দিকে আর কেহ চাহিয়াও দেখিত না ।  কিন্তু ইহাদের মধ্যে কেহ যদি রাজকন্যার মনােমত হইতেন, তবে রাজকন্যা
তাহার গলদেশে বরমাল্য অর্পণ করিতেন এবং তিনিই রাজকন্যার স্বামী রাজকন্যার এরূপ স্বয়ংবর-সভা হইতেছিল। এই রাজকন্যা পৃথিবীর মধ্যে
হইতেন। যে-দেশে আমাদের পূর্ব-কথিত রাজা ও সন্ন্যাসী আসিয়াছেন, সেই দেশের
সর্বাপেক্ষা সুন্দরী ছিলেন। ঘােষিত হইয়াছিল যে, রাজার মৃত্যুর পর। রাজকন্যাই রাজ্য লাভ করিবেন। এই রাজকন্যার ইচ্ছা ছিল, সর্বাপেক্ষা।
সুপুরুষকে বিবাহ করেন, কিন্তু তাহার মনের মতাে সুপুরুষ পাওয়া যাইতেছিল না।
 অনেকবার এইরূপ স্বয়ংবর-সভা আহূত হয়, তথাপি রাজকন্যা কাহাকেও মনােনীত করিতে পারেন নাই। এই স্বয়ংবর-সভাই সর্বাপেক্ষা বৃহৎ হইয়াছিল।
এই সভায় পূর্ব পূর্ব বার অপেক্ষা অধিকতর লােক সমবেত হইয়াছিল, এবং এই সভার দৃশ্য অতি চমৎকার ও অদ্ভুত হইয়াছিল ।  সিংহাসনে সমাসীনা রাজকন্যা সভায় প্রবেশ করিলেন এবং বাহকগণ
তাহাকে সভামধ্যে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে লইয়া যাইতে লাগিল। রাজকন্যা কাহারও দিকে ভ্রুক্ষেপ করিলেন না। এবারেও স্বয়ংবর-সভা পূর্ব পূর্ব বারের মতাে ব্যথ
হইবে ভাবিয়া সকলেই নিরুৎসাহ হইতে লাগিল। এমন সময় এক যুবা।
সন্ন্যাসী সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন; তাহার রূপের প্রভা দেখিয়া বােধ হইল যেন স্বয়ং সূর্যদেব আকাশমার্গ ছাড়িয়া ধরাতলে অবতীর্ণ হইয়াছেন এবং
সভার এককোণে দাড়াইয়া দেখিতেছেন—কি হইতেছে। রাজকন্যাসহ সেই । সিংহাসন তাহার নিকটবর্তী হইল। রাজকন্যা সেই পরম রূপবাবামাত্র বাহকদিগকে থামিতে বলিয়া সন্ন্যাসীর গলদেশে বরমাল্য অর্পণ করিলেন। যুবা সন্ন্যাসী মালা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিলেন ও বলিতে লাগিলেন, এ
কি নির্বুদ্ধিতা। আমি সন্ন্যাসী ; আমার পক্ষে বিবাহের অর্থ কি ?' সেই দেশের । রাজা মনে করিলেন, লােকটি বােধ হয় দরিদ্র, সেইজন্য রাজবাহ।
করিতে সাহস করিতেছে না ; অতএব তিনি বলিলেন, “আমার কন্যার সহিত। তুমি এখনই অর্ধেক রাজত্ব পাইবে এবং আমার মৃত্যুর পর সমগ্র রাজ্য। এই
বলিয়া সন্ন্যাসীর গলায় আবার মালা পরাইয়া দিলেন। “কি বাজে কথা ! দ্রুতপদে সেই সভা হইতে প্রস্থান করিলেন। এদিকে এই যুবকের প্রতি রাজকন্যা এতদিন অনুরক্ত হয়েছেন যে, তিনি বলিলেন, ‘হয় আমি ইহাকে বিবাহ করিব, নতুবা মরিব। রাজকন্যা তাহাকে ফিরাইয়া আনিবার জন্য তাহার অনুবর্তন করিলেন। তারপর
আমাদের সেই অপর সন্ন্যাসী—যিনি রাজাকে সেখানে।
আনিয়াছিলেন বলিলেন, ‘চলন রাজা, আমরা এই দুইজনের অনুগমন করি।। এই বলিয়া তাহার অনেকটা দূরে দূরে থাকিয়া তাহাদের পিছনে পিছনে চলিতে লাগিলেন। যে-সন্ন্যাসী রাজকুমারী পানি গ্রহণে অসম্মত হয়েছেন, তিনি রাজধানী হইতে বাহির হইয়া কয়েক ক্রোশ গ্রামের মধ্য দিয়ে চলিতে চলিতে এক বনে প্রবেশ করিলেন, রাজকন্যা তাহার অনুগমন করিলেন;
অপর দুইজনও তাহাদের পিছনে পিছনে চলিলেন।
এই যুবা সন্ন্যাসী ঐ বনটিকে ভালভাবেই জানিতেন ; উহার কোথায় কি আঁকাবাঁকা পথ আছে, সব জানতেন। সন্ধ্যা-সমাগমে হঠাৎ তিনি এরূপ একটি জটিল পথে প্রবেশ করিয়া একেবারে অন্তর্হিত হইলেন। রাজকন্যা তাহার আর কোন সন্ধান পাইলাম না। অনেকক্ষণ ধরিয়া তাহাকে খুজিয়া পাওয়া  গেলো না
তিনি একটি বৃক্ষতলে বসিয়া কাঁদিতে লাগিলেন, কারণ তিনি সেই বন হইতে । বাহিরে আসিবার পথ জানিতেন না। তখন সেই রাজা ও অপর সন্ন্যাসটি । তাঁহার নিকট আসিয়া বলিলেন, কাদিও না, আমরা তােমাকে এই বনের । বাহিরে যাইবার পথ দেখাইয়া দিব। কিন্তু এখন অন্ধকার যেরূপ গাঢ়, তাহাতে পথ বাহির করা বড় কঠিন, এই একটা বড় গাছ রহিয়াছে ; এস, আজ আমরা । ইহার তলায় বিশ্রাম করি। প্রভাতে তােমাকে বাহির হইবার পথ দেখাইয়া দিব।
সেই গাছে এক পাখির বাসা ছিল। তাহাতে একটি ছােট পাখি, পক্ষিণী ও । তাহাদের তিনটি ছােট ছােট শাবক থাকিত। ছােট পাখিটি নিচের দিকে।
চাহিয়া গাছের তলায় তিনজন লােককে দেখিল এবং পক্ষিশাকে বলি দেয় । কি করা যায় আমাদের ঘরে কয়েকজন অতিথি আসিয়াছে-শীতকাল, আর
আমাদের নিকট আগুনও নাই।' এই বলিয়া সে উডিয়া (গোল ঠোটে বিমা। একখণ্ড জ্বলন্ত কাঠ লইয়া আসিল এবং উহা তাহার অতিথিগণের সম্মুখে ফেলিয়া দিল। তাহারা সেই অগ্নিখণ্ডে কাঠকুটা দিয়া বেশ আগুন প্রস্তুত করিলেন। কিন্তু পাখিটির তাহাতেও তৃপ্তি হইল না। সে তাহার পত্নীকে বলিল, ‘প্রিয়ে, আমরা কি করি? ইহাদিগকে খাইতে দিবার মতাে কিছুই তাে
আমাদের ঘরে নাই; কিন্তু ইহারা ক্ষুধার্ত, আর আমরা গৃহস্থ ; ঘরে যে-কেহ। আসিবে, তাহাকেই খাইতে দেওয়া আমাদের কর্তব্য। আমি নিজে যতদূর পারি করিব। ইহাদিগকে আমি আমার শরীরটাই দিব।' এই বলিয়া সে উড়িয়া।  গিয়া বেগে সেই অগ্নির মধ্যে পডিল ও মরিয়া গেল। অতিথিরা তাহাকে । পড়িতে দেখিলেন, এবং তাহাকে বাচাইবার যথাসাধ্য চেষ্টা করিলেন, কিন্তু সে।
এত দ্রুত আসিয়া আগুনে পড়িল যে, তাহারা বাচাইতে পারিলেন না। পক্ষিণী তাহার স্বামীর কার্য দেখিয়া মনে মনে বলিল, 'এরা তিনজন। রহিয়াছেন, তাহাদের খাইবার জন্য মাত্র একটি ছােট পাখি! ইহা যথেষ্ট নয়।
শরীরও ইহাদের জন্য উৎসর্গ করি।' এই বলিয়া সেও আগুনে ঝাপ দিল এবং স্ত্রীর কর্তব্য—স্বামীর কোন উদ্যম বিফল হইতে না দেওয়া। অতএব আমার
পুড়িয়া মরিয়া গেল। শাবক-তিনটি সবই দেখিল, কিন্তু ইহাতেও তিনজনের পর্যাপ্ত খাদ্য হয়
নাই দেখিয়া বলিল, 'আমাদের পিতামাতা যতদূর সাধ্য করিলেন, কিন্তু তাহাও তাে যথেষ্ট হইল না। পিতামাতার কার্য সম্পূর্ণ করিতে চেষ্টা করা সন্তানের
কর্তব্য ; অতএব আমাদের শরীরও এই উদ্দেশ্যে সমর্পিত হউক'—এই বলিয়া তাহারাও সকলে মিলিয়া অগ্নিতে ঝাপ দিল। এ তিন ব্যক্তি যাহা দেখিলেন, তাহাতে আশ্চর্য হইয়া গেলেন, কিন্তু । পাখিগুলিকে খাইতে পারিলেন না। কোনরূপে তাহারা অনাহারে রাত্রি যাপন করিলেন। প্রভাত হইলে রাজাসন্ন্যাসী সেই রাজকন্যাকে পথ দেখাইয়া দিলেন, এবং তিনি তাহার পিতার নিকট ফিরিয়া গেলেন। তখন সন্ন্যাসী রাজাকে সম্বােধন করিয়া বলিলেন, “রাজ, দেখিলেন তাে।
নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই বড়। যদি সংসারে থাকিতে চান, তবে এ পাখিদের মতাে প্রতিমুহূর্তে পরার্থে নিজেকে উৎসর্গ করিবার জন্য প্রস্তুত
হইয়া থাকুন। আর যদি সংসার ত্যাগ করিতে চান, তবে ঐ যুবকের মতাে হউন, যাহার পক্ষে পরমা সুন্দরী যুবতী ও রাজ্য অতি তুচ্ছ মনে হইয়াছিল।।
যদি গৃহস্থ হইতে চান, তবে আপনার জীবন সর্বদা অপরের কল্যাণের জন্য উৎসর্গ করিতে প্রস্তুত থাকুন। আর যদি আপনি ত্যাগের জীবনই বাছিয়া লন,
তবে সৌন্দর্য ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার দিকে মােটেই দৃষ্টিপাত করিবেন না।নিজ নিজ কর্মক্ষ্রেত্রে  প্রতেকেই বড় 
  কিন্তু একজনের যাহা কতব্য, তাহা । অপরজনের কর্তব্য নয়।।নিজ নিজ কর্মক্ষ্রেত্রে  প্রতেকেই বড়

Life history more... 

...........................Life History........................  

No comments:

Powered by Blogger.